পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র-বাংলাদেশের সম্ভাবনা by মেসবাহুর রহমান টুটুল

বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ঝামেলাযুক্ত বিষয় ছিল পারমাণবিক জ্বালানি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। আয়তনে ছোট এবং অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এ বর্জ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা এ দেশের জন্য যেমন অনিরাপদ তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আশার কথা, চুক্তি অনুসারে রাশিয়ার সরকার এ পরমাণু জ্বালানি বর্জ্য বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাবে বাংলাদেশ আণবিক শক্তির যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থা দ্য স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশনের


(রোসটাম) সঙ্গে গত ২ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি সই হয়েছে। চুক্তি অনুসারে রোসটাম পাবনার রূপপুরে এক হাজার মেগাওয়াট একক ইউনিটের দুটি মোট দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র্র নির্মাণ করে দেবে এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র্র নির্মাণে আইনি কাঠামো তৈরি করা, অর্থায়ন, নির্মাণ, পরিচালন ও সংরক্ষণ, বাংলাদেশের পেশাজীবীদের দীর্ঘমেয়াদে প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ শেষে পরিচালন ও সংরক্ষণের দায়িত্ব ধাপে ধাপে হস্তান্তর, যতদিন প্লান্ট চলবে ততদিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্র্রাথমিক জ্বালানি অর্থাৎ ইউরেনিয়াম সরবরাহ করা, পারমাণবিক জ্বালানি বর্জ্য বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া এবং বিনিয়োগ উসুল শেষে বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর ইত্যাদি করবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। পুরোটাই রাশিয়া বাংলাদেশকে ঋণ হিসেবে দেবে। ঋণ সহায়তার জন্য পরে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে রাশিয়ার পৃথক একটি চুক্তি হবে। রোসটামের মহাপরিচালক বলেছেন, ৫ বছরে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে। ২০১৩-এর শুরুতে তারা কাজ শুরু করবে। আণবিক শক্তির যুগে প্রবেশ হবে বাংলাদেশের জন্য মাইলফলক। পৃথিবীতে মাত্র ৩০টি দেশ এ পর্যন্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ ৩১তম দেশ হিসেবে জায়গা করে নিতে যাচ্ছে।
২০০৭ সালের জুন মাসে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অনুমতি দেয়। জাতিসংঘের অনুমতি ছাড়া কোনো দেশ চাইলেও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে পারে না। ২০০৮ সালের মে মাসে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বাংলাদেশকে তাদের সদর দফতর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় আমন্ত্রণ জানায়। বাংলাদেশ সেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আগ্রহের কথা জানিয়েছিল। ফলোআপ হিসেবে ওই বছরের নভেম্বরে আইএইএর প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে এবং প্রকল্প এগিয়ে নিতে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। একই সঙ্গে তারা ১৯ দফা পরামর্শ ও নির্দেশনা দেয়। বর্তমান সরকার অত্যন্ত যত্ন ও আগ্রহের সঙ্গে এই ১৯ দফা বাস্তবায়ন করছে। ২০০৯-এর প্রথম দিকে মহাজোট সরকার দেশ পরিচালনায় দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র্র নির্মাণে পদক্ষেপ নেয়। বাংলাদেশের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে আইএইএ সন্তুষ্ট হয়েছে বলেই বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারল। গত দু'বছরে সরকার পরমাণু শক্তি সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন, নিয়ম, বাধ্যবাধকতা নীরবে অনুসরণ, প্রতিপালন ও বাস্তবায়ন করে গেছে। যেহেতু এ নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা বিশেষ হয়নি, তাই আমরা জনগণ তেমন একটা বুঝতে পারিনি। আমাদের অভ্যাস (বদভ্যাস) হলো নতুন একটা কিছু করার চিন্তা বা পরিকল্পনা করলেই তা নিয়ে মিডিয়াতে হুলস্থূল শুরু করে দেওয়া। 'খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি।' উৎসুক হয়ে তাই বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দু'বছরে এত কিছু করে ফেললেন, অথচ কোনো 'বাজনা' নেই। তিনি স্বভাবসুলভ মৃদু হেসে বললেন, 'কথা কম কাজ বেশি।' চার লাইনের চমৎকার একটা ছড়াও শোনালেন। তাকে অভিনন্দন জানালাম। তিনি বললেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে।
ছোটবেলা থেকে শুনছি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা। ১৯৬১ সালে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ১৯৬৩ সালে পাবনার রূপপুরে ২৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ব্যস, এ পর্যন্তই। আর এগোয়নি। জাতি প্রায় ভুলতেই বসেছিল এ প্রকল্পের কথা। ৫০ বছর পর আশা করা যাচ্ছে, এ প্রকল্প আলোর মুখ দেখতে পাবে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুবিধা হলো, এখানে জ্বালানি খরচ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম এবং গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে এক-পঞ্চমাংশ কম। পরমাণু জ্বালানি দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য পড়বে ইউনিটপ্রতি এক টাকার কিছু বেশি। অথচ ফার্নেস তেল দিয়ে প্রতি ইউনিট সাত টাকার বেশি পড়ে।
বিশ্বে প্রচলিত জ্বালানির চেয়ে পরমাণু জ্বালানির মজুদ অনেক বেশি। পৃথিবীতে মূলত দুটি উৎস থেকে ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। ভূগর্ভ এবং সাগর জল থেকে। ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী উত্তোলনযোগ্য ইউরেনিয়ামের পরিমাণ প্রায় ৫৪ লাখ ৪ হাজার টন। সাগর জলে যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম আছে, শুধু তা দিয়েই পৃথিবীতে ৭০ লাখ বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। পারমাণবিক চুলি্লর ব্যাপক প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়ামের খরচ হবে একেবারেই নগণ্য। এই চুলি্লতে যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম জ্বালানি খরচ হবে, খরচের মধ্য হতে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ইউরেনিয়াম/প্লুটোনিয়াম জ্বালানি তৈরি হবে। ফলে ইউরেনিয়ামের ব্যবহার হবে অফুরন্ত এবং অসীম।
দেশে সীমিত মজুদ গ্যাস এবং বিপুল কার্বন নিঃসরণকারী কয়লার স্থলে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে একাধারে পরিবেশবান্ধব এবং মূল্য সাশ্রয়ী। ফ্রান্সের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৭৮%, বেলজিয়ামে ৫৮% এবং জাপানের ৫৬% আসে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপনা ব্যয় বেশি হলেও প্রাথমিক জ্বালানি, পরিচালন ও সংরক্ষণ ব্যয় অত্যন্ত কম। রোসাটম বলেছে, প্রস্তাবিত এনপিপি থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই বিনিয়োগ উঠে আসবে। বাংলাদেশে স্থাপিত গ্যাসনির্ভর ও তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল গড়ে যথাক্রমে ২৫ ও ৩৫ বছর। বাংলাদেশে স্থাপিতব্য পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আয়ু হবে পূর্ণ ক্ষমতায় ৬০ বছর এবং ক্ষয়প্রাপ্তিকালসহ ৮০ বছর। দেশে সীমিত গ্যাসের মজুদ, জলবিদ্যুতের অপ্রাপ্যতা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে ভবিষ্যতে পরিবেশ রক্ষায় কয়লা পোড়ানোর ওপর সম্ভাব্য বিধিনিষেধ মাথায় রেখে পর্যায়ক্রমে পরমাণু বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল থেকে আমাদের এখন থেকেই পরিকল্পনা করে এনপিপি স্থাপন করার দিকে ঝুঁকতে হবে। এর ফলে নির্ভরযোগ্য প্রাথমিক জ্বালানি প্রাপ্তি নিশ্চিত হওয়া যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে জ্বালানি তেল আমদানির ওপর চাপ কমানো যাবে।
বাংলাদেশে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হবে, তা হবে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থাপনা হলো পারমাণবিক চুলি্ল। চলমান প্রযুক্তিতে যা পানি দিয়ে শীতল রাখার ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশে স্থাপিতব্য এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুলি্লকে পানি ছাড়াও বায়ু দিয়ে শীতল রাখার ব্যবস্থা রাখা হতে পারে। বায়ু দ্বারা পারমাণবিক চুলি্ল শীতল রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে বিশ্বে আবিষ্কৃত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। শুধু তাই নয়, কোনো যান্ত্রিক বা দুর্যোগের মুখোমুখি হলে এ প্লান্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। ১৯৮৬ সালে ইউক্রেনের চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে নিরাপদ ও বিপদমুক্ত রাখার জন্য এমন সব ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং তা এতটাই সুরক্ষিত, যা অঙ্কের হিসাবে প্রায় শতভাগ।
৪০ বছরের পুরনো ফুকোসিমা বিদ্যুৎকেন্দ্র পৃথকভাবে ভূমিকম্প ও সুনামি রোধক ছিল। জাপানের ফুকোশিমা দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে রোসাটম বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে নতুন মাত্রায় ৫ স্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখবে। যেখানে একসঙ্গে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ও সুনামিরোধক এবং পারমাণবিক চুলি্ল শীতল করার সর্বাধুনিক ব্যবস্থা থাকবে। এ জন্য তারা নতুন নকশায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। বাংলাদেশে নির্মিতব্য তৃতীয় প্রজন্মের এ বিদ্যুৎকেন্দ্র্রে ৪ হাজার মেট্রিক টন ভরবেগে বিমান আছড়ে পড়লেও বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো ক্ষতি হবে না।
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ঝামেলাযুক্ত বিষয় ছিল পারমাণবিক জ্বালানি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। আয়তনে ছোট এবং অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এ বর্জ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা এ দেশের জন্য যেমন অনিরাপদ তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আশার কথা, চুক্তি অনুসারে রাশিয়া সরকার এ পরমাণু জ্বালানি বর্জ্য বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাবে।
জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকলে পারা যায় না এমন কোনো কাজ নেই। বাঙালি জাতি তা বারবার প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশ পারবে। '৬৬ থেকে '৭১। ছিল না মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, কম্পিউটার, গুগল, টুইটার, ফেসবুক, উইকিলিকস। কিন্তু ছিল বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল নেতৃত্ব। তাই তো ৪০ বছর আগে ওই নেতার ডাকে খালি হাতে প্রশিক্ষিত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়তে বাঙালি জাতি উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এবং জয় করেছিল। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ জাতি 'বিদ্যুৎযুদ্ধে' নেমেছে। প্রথম পর্যায়ে সফল হওয়া গেছে। এ যুদ্ধে চূড়ান্ত পর্যায়ে সফল হতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি 'পারমাণবিক বিদ্যুৎযুদ্ধে' সফল হবেই।

প্রকৌশলী মেসবাহুর রহমান টুটুল :ভাইস প্রেসিডেন্ট, আইইবি
entutul@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.