জয়পুরহাট-২ আসন : আওয়ামী লীগ-কারো পকেট ভরা কারো মন মরা! by আলমগীর চৌধুরী

কালাই, ক্ষেতলাল ও আক্কেলপুর_এই তিনটি উপজেলা নিয়ে গঠিত জয়পুরহাট-২ নির্বাচনী এলাকা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে থাকলেও ১৯৭৫ সালের পর থেকে তা বিএনপির দখলে চলে যায়। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় শুধু ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগপ্রার্থী জয়লাভ করেন। দীর্ঘদিন ধরে এই আসনে বিএনপিপ্রার্থী জয়ী হলেও গৃহবিবাদের কারণেই মূলত আওয়ামী লীগ এখানে বারবার পরাজিত হয়েছে,


যার মূল দ্বন্দ্বই দলীয় মনোনয়ন নিয়ে। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামতকে উপেক্ষা করে বহিরাগতদের বার বার মনোনয়ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট কোন্দলই পরবর্তীকালে দানা বেঁধে জটিল আকার ধারণ করে, যা কেন্দ্র থেকে নিরসনের চেষ্টাও করা হয়নি। তবে বিগত সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। বিগত প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে পরাজিত হলেও গত নির্বাচনে মাত্র তিন হাজার ১৫৯ ভোটের ব্যবধানে মহাজোটপ্রার্থী পরাজিত হন। নির্বাচনে বিএনপিপ্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা পেয়েছিলেন এক লাখ ১৬ হাজার ৮৮০ ভোট। আর স্বপন পেয়েছিলেন এক লাখ ১৩ হাজার ৭২১ ভোট। স্বপন প্রার্থী হওয়ার পর থেকে প্রার্থিতা নিয়ে দলের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি না থাকলেও দল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিভিন্ন সভায় তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি গত তিন বছরেও বাস্তবায়ন না হওয়ায় সাধারণ নেতা-কর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে ক্ষমতায় থাকায় কেউ মুখ খুলছেন না। এ ছাড়া তিন থানায় আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠনের উপজেলা কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় ভেঙে পড়েছে নেতা-কর্মীদের চেইন অব কমান্ড। ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড, ওয়ার্ড থেকে গ্রাম_কোনোখানেই নেই নেতা-কর্মীদের মধ্যে সমন্বয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এলাকায় সফরে এলে নেতা-কর্মীদের সমবেত হওয়া ছাড়া দলীয় কোনো কর্মসূচিতে একত্রিত হতে দেখা যায়নি।
কালাই : ক্ষমতায় আসার পর যেন আর কোনো দায়ই নেই দলের ব্যাপারে। নেই দলীয় কোনো কার্যালয়। দলীয় কর্মসূচি পালনেও মাথাব্যথা নেই নেতাদের। তাঁরা ব্যস্ত নিজেদের আখের গোছানো নিয়ে। উপজেলা কমিটির বয়স ১৭ বছর। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি হলেও কালাই আওয়ামী লীগ মূলত এখন দুই ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষে আছেন কালাইয়ের প্রয়াত জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা মাহফুজার রহমান মন্টুর ছেলে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিনফুজুর রহমান মিলন এবং সভাপতি হালিমুল আলম জন। আর অন্যদিকে আছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও কালাই পৌরসভার মেয়র তৌফিকুল ইসলাম বেলাল। নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, দ্বিধাবিভক্তির কারণে বিপদেও নেতাদের পাশে পাওয়া যায় না।
কালাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং মাত্রাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আ ন ম শওকত হাবিব লজিক জানান, নেতৃত্বে বিভক্তি থাকায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে কালাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। এমনকি দলের কোনো দিবসও পালন করা হয় না ক্ষমতায় আসার পর থেকে। শীর্ষ নেতৃত্বের এই কোন্দল মেটানোর জন্য আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন চেষ্টা করেন উভয় পক্ষকে একত্রিত করার। এ অবস্থায় বিবদমান দুই গ্রুপের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম বৈঠক বসে পৌরসভায়। সেখানে প্রাথমিক আলোচনা সম্পন্ন হওয়ার পর আবারও বৈঠক বসার সিদ্ধান্ত হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল কাদেরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরাইলের নরওয়েস্ট হিমাগারে ৩ অক্টোবর বৈঠক বসার সিদ্ধান্তও সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু বৈঠকে উপজেলা চেয়ারম্যানের গ্রুপ উপস্থিত হলেও পৌর মেয়র গ্রুপ না আসায় সমঝোতা উদ্যোগ ভেস্তে যায়। সেই থেকে দ্বিখণ্ডিত নেতৃত্বেই চলছে কালাই উপজেলা আওয়ামী লীগ। দলের দপ্তর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন জানান, কালাই আওয়ামী লীগ চলছে উপজেলা চেয়ারম্যান আর পৌর মেয়রের বিপরীত নেতৃত্বে। এখানে দলের কোনো কর্মকাণ্ড নেই। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'দলের দুর্দিনে আমরা যারা দলের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করেছি, তারা খেয়ে আছি, নাকি না খেয়ে আছি, নেতারা এখন সেই খবর জানারও প্রয়োজন মনে করেন না।' তিনি মহাজোটপ্রার্থী এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বিগত সংসদ নির্বাচনের আগে স্বপন ভাই যতবার কালাই এসেছেন, ততবারই তাঁকে ফোন করে ডেকে নিয়েছেন। অথচ এখন আর তাঁদের কোনো খোঁজ-খবর নেওয়া হয় না।
উপজেলা চেয়ারম্যান মিনফুজুর রহমান মিলন বলেন, 'কালাইয়ে দলের কার্যক্রম না থাকায় মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ঝিমিয়ে পড়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনার মতো যেকোনো ভালো পদক্ষেপ দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ালেও কালাইয়ে দল থেকে সেই ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কতিপয় নেতা এখন অর্থ রোজগারে মাঠে নেমেছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
পৌর মেয়র তৌফিকুল ইসলাম বেলাল অবশ্য দল সম্পর্কে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ। দল আগের চেয়ে এখন শক্তিশালী দাবি করে তিনি বলেন, ২০০৪ সালের কমিটি দিয়ে দল পরিচালিত হলেও খুব শিগগিরই দলের তৃণমূল থেকে পর্যায়ক্রমে উপজেলা কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে, যা কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ ঘোষণা দিয়ে গেছেন।
ক্ষেতলাল : উপজেলা আওয়ামী লীগ চলছে চার নেতার নেতৃত্বে। তবে দলকে গতিশীল করতে নয়, নিজেদের অবস্থান মজবুত রাখতে কাজ করছেন এসব নেতা। ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর ক্ষেতলাল সদরকে পৌরসভা ঘোষণার পর থেকে ক্ষেতলাল আওয়ামী লীগের এই অবস্থা বিরাজ করছে। ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা দলের নেতৃত্বের কোন্দল নিয়ে নিজেরাই বিব্রত। উপজেলা কমিটি বিলুপ্তির পর বড়াইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানকে আহ্বায়ক এবং আবদুল মজিদ মোল্লা ও সিরাজুল ইসলামকে যুগ্ম-আহ্বায়ক ঘোষণা দিয়ে ৬১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আর এই কমিটির মেয়াদ এক বছর অতিক্রম করলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে কোনো তৎপরতা নেই। ফলে সেই থেকে দৃশ্যত দলীয় কোনো কর্মসূচি নেই। মাঝেমধ্যে কেন্দ্রীয় নেতা আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এলাকায় এলেই কেবল নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যায়। আহ্বায়ক কমিটি গঠন নিয়েও দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। উপজেলা সদরকে পৌরসভা ঘোষণার পর যে পৌর কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা নিয়েও দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এই কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে বিএনপি করেন এমন নেতা-কর্মীরাও স্থান পেয়েছেন। তবে এসব ব্যাপারে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছেন না। দলের উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যন্ত শতাধিক নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে দল সম্পর্কে এমন ধারণাই পাওয়া গেছে।
আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মোফাজ্জল হোসেন জানান, আহ্বায়ক খলিল এবং যুগ্ম আহ্বায়ক মজিদ মোল্লা ও সিরাজুল ইসলাম_এই তিনজন এখন ক্ষেতলাল আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা। তাঁদের দিকনির্দেশনায় চলছে ক্ষেতলাল আওয়ামী লীগ। স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা রুবেল বলেন, 'পৌর নির্বাচন নিয়ে আমরা বিপদে আছি। কারণ, আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে মাঠে এখন জনসংযোগ করছেন আহ্বায়ক কমিটির প্রথম সারির তিন নেতা। কাজেই আহ্বায়কের সঙ্গে কথা বললে যুগ্ম আহ্বায়করা মন খারাপ করেন। আবার যুগ্ম আহ্বায়কদের সঙ্গে দেখলে আহ্বায়ক নাখোশ হন। আমরা এখন কোন দিকে যাই?
আহ্বায়ক খলিলুর রহমান বলেন, 'যে যত কথাই বলুক, সবার মতামতকে প্রাধান্য দিয়েই আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। একসময় যারা দলকে ব্যবহার করে ফায়দা লুটেছে, সেসব সুবিধাবাদী দলে স্থান না পেয়ে দল সম্পর্কে নানা রকম কটূক্তি করছেন। যুগ্ম আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম জানান, আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হলেও জেলা কমিটিতে তা এখনো অনুমোদন পায়নি। অনুমোদন পেলে ছয় মাসের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে।
আক্কেলপুর : উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোকছেদ আলী মাস্টার গত উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর থেকে এখন দলে অনেকটা নিষ্ক্রিয়। একইভাবে পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হওয়ার পর একই অবস্থা সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হুদা হালাকুর। আর এই সুযোগে সাধারণ সম্পাদকের পদ নিতে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং রুকিন্দীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মাহফুজ চৌধুরী অবসর মাঠে নেমেছেন। ইতিমধ্যে আক্কেলপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পলিট ব্যুরো সদস্য আনোয়ারুল হক বাবলুর বিপক্ষে তিনি আক্কেলপুর মুক্তমঞ্চে জনসভাও করেন। সেখানে আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মীকে ঐক্যবদ্ধ রাখারও উদ্যোগ নেন। এ নিয়ে আক্কেলপুরে আওয়ামী লীগ বনাম উপজেলা চেয়ারম্যান পক্ষ পাল্টাপাল্টি সমাবেশও করে।
গোলাম মাহফুজ চৌধুরী বলেন, 'উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক বাবলু আক্কেলপুরবাসীকে জিম্মি করে রাজনীতি করছেন। ভয়ে তাঁর বিপক্ষে কেউ কথা বলে না। আমি বিপুল ভোটে রুকিন্দীপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জয়লাভ করার পর পরিষদে এসে তাঁর অনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে প্রতিবাদ করি।' তিনি বলেন, 'শুধু আমি নই, বিএনপির নেতা-কর্মীরাও এখন উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গ ত্যাগ করেছেন।'
অন্যদিকে উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক বাবলু বলেন, 'সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আক্কেলপুরের উন্নয়নে কাজ করছি। আর এসব কারণে সরকারি দলে থেকেও ফায়দা লুটতে না পেরে সবেমাত্র ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েই অনেকটা গায়ে পড়ে বিরোধিতা শুরু করেছেন অবসর চৌধুরী। তবে তিনি বলেন, 'আমি ভালো করেছি, না খারাপ করেছি, এলাকার জনগণই তার জবাব দেবে।' তিনি আক্কেলপুর রেলস্টেশনে মানুষকে টিকিট কেটে রেল ভ্রমণে উদ্বুদ্ধকরণসহ রেলের জমি বেদখল থেকে রক্ষা করার মতো উদাহরণ টেনে বলেন, এলাকার উন্নয়নে সর্বস্তরের মানুষ আগেও যেমন তাঁর পাশে ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জানান, ক্ষেতলাল-কালাই-আক্কেলপুর উপজেলার মানুষ তাঁকে নির্বাচিত না করলেও সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক উন্নয়ন করার লক্ষ্যে তিনি কাজ করছেন। তিনি ক্ষেতলালকে পৌরসভায় উন্নীতকরণসহ উন্নয়নের নানা ফিরিস্তি তুলে ধরে বলেন, আগামী দুই বছরে এলাকার উন্নয়নে আরো ব্যাপক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। দলের কমিটি গঠনের ব্যাপারে তিনি বলেন, জানুয়ারি মাস থেকেই দল গোছানোর কাজ শুরু করা হবে। আর কমিটি গঠন হলেই দল আরো গতিশীল হবে।

No comments

Powered by Blogger.