রাজনীতি-আওয়ামী লীগের কারণে মহাজোট এখন কাগুজে! by পাভেল হায়দার চৌধুরী

ওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন মহাজোট এখন অনেকটাই কাগুজে জোটে পরিণত হয়েছে। জোটগত কোনো কার্যক্রম নেই। জাতীয় দিবসগুলোতে আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে শরিক দলের নেতাদের উপস্থিতি নেই আগের মতো। সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে শরিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলসহ সংবিধান সংশোধন, ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তি এবং সর্বশেষ মন্ত্রিসভায় রদবদলসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও


মহাজোটের শরিকদের মতামত নেওয়া হয়নি। সরকারের অনেক সিদ্ধান্তে সমর্থন দেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো বিরোধিতা করছে শরিকরা।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্বের কথা শরিকরা অকপটে স্বীকার করলেও আওয়ামী লীগের নেতারা তা অস্বীকার করে বলছেন, জোট-মহাজোটের শরিকদের সঙ্গে কোনো দূরত্ব নেই। শরিকদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে।
মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সর্বশেষ টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করছেন তিনি। মহাজোট নেতা ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাও সম্প্রতি এরশাদের সমালোচনা করে সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন।
পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে শুধু 'নির্বাচনকেন্দ্রিক' জোট চায় না ১৪ দল ও মহাজোটের অন্য শরিকরা। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সরকার পরিচালনা_সব ক্ষেত্রে কার্যকর অংশীদারিত্ব চায় তারা। আর কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করে আগামী বছরের শুরুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এ বিষয়ে রীতিমতো বোঝাপড়া করতে চাচ্ছেন তারা। আওয়ামী লীগের 'একলা চলো' নীতি অব্যাহত থাকলে জোট, মাহাজোট ও সমমনা অন্য সংগঠনগুলো আগামী দিনে বিকল্প চিন্তা করবে_এমন আভাসও দিয়েছেন শরিক দলের নেতারা।
শরিকদের দাবি, সরকার বা আওয়ামী লীগ কোনো সিদ্ধান্তই সম্মিলিতভাবে নিচ্ছে না। তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও নেই। এরই মধ্যে জাতীয় পার্টিও একলা চলো নীতি গ্রহণ করেছে। টিপাইমুখ ইস্যুতে লংমার্চ করেছে দলটি। পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ লংমার্চ কর্মসূচিতে সরকারের নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্তের বাইরে কথা বলেছেন প্রকাশ্যে।
সংবিধান সংশোধন ইস্যুতে ১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের ছিল ভিন্নমত। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে তাদের মতামত প্রতিফলিত হয়নি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ধীরগতি এবং এ প্রক্রিয়ায় কিছু ত্রুটির সমালোচনা করেছে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু কালের কণ্ঠকে জানান, জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে জাতীয় পার্টি কিছু বিষয়ে একাধিক কর্মসূচি পালন করেছে। সারা দেশে জাতীয় পার্টির শক্তি-সামর্থ্য যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে আগামীতে একলা নির্বাচনও করতে পারেন তাঁরা।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন কালের কণ্ঠকে বলেন, আসলে নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট চান না তাঁরা। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে এই জোটের জন্ম। ক্ষমতায় আসার পর জোটের সেই লক্ষ্যচ্যুতি ঘটেছে। তিনি বলেন, শরিক দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতা জোটকে দুর্বল করে ফেলছে। কোনো বিষয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের আলাপ-আলোচনা নেই। এ অবস্থা সামনে সমস্যার সৃষ্টি করবে। ভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন বিচ্ছিন্নতা জটিলতার সৃষ্টি তো করতেই পারে। বিকল্প মোর্চা গঠন হতে পারে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর জানা নেই।
এ বছরের প্রথমদিকে জোটের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে। তিনি কয়েকটি বৈঠক করেন। এরপর তা আর এগোয়নি। ওই সব বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলেও অভিযোগ আছে শরিক দলের নেতাদের। সরকারের বয়স তিন বছর হতে চলেছে। এর মধ্যে মাত্র তিনবার ১৪ দলের সঙ্গে বেঠক করেছেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে বাম নেতারা মহাজোট নেত্রীর কাছে বেশ কয়েকটি দাবি উত্থাপন করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে_১৪ দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর চালু, তিন মাস পর পর বৈঠকের ব্যবস্থা এবং প্রতি জেলায় ১৪ দলের সমন্বয়ে কমিটি গঠন, আইনশৃঙ্খলা কমিটিতে ১৪ দলকে যুক্ত করা। কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। বাম নেতারা বলছেন, সংবিধান সংশোধনসহ আরো বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নানা কারণে বাম নেতাদের দাবি-দাওয়া খুব একটা গ্রাহ্য করা হয় না। এ জন্য মহাজোটের সংঘবদ্ধ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অবশ্য কালের কণ্ঠকে বলেন, জোটের সঙ্গে তাঁদের আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। তবে সেটা কম। শিগগিরই শরিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বসার আয়োজন চলছে। এ ব্যাপারে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে বলে জানান আশরাফ।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, রাজনৈতিক ও সরকারি কর্মকাণ্ডে শরিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে না। এতে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। তবে সময়মতো সব ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি দাবি করেন।
নামে ১৪ দল, আসলে ৯ দল
নামে ১৪ দলীয় জোট হলেও আসলে ৯ দলীয় জোট। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দলগুলো হলো_ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), সাম্যবাদী দল, ন্যাপ (মোজাফ্ফর), গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণ-আজাদী লীগ ও গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও জাতীয় পার্টি ছাড়া অন্য দলগুলো একেবারেই অদৃশ্য। ১৪ দল থেকে গণফোরাম বেরিয়ে গেছে আগেই।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে তরিকত ফেডারেশনেরও সমর্থন ছিল আওয়ামী লীগের প্রতি। এখন তারাও সক্রিয় নয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে। এ ব্যাপারে তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন ছিল তাঁদের। কিন্তু পরবর্তী অনেক কার্যকলাপে তাঁদের আপত্তি রয়েছে। আগামী দিনে সমর্থন থাকবে কি না তা জানেন না তিনি।
আওয়ামী লীগের পর মহাজোটের সবচেয়ে বড় শরিক এরশাদের জাতীয় পার্টি। মন্ত্রিসভায় একজন সদস্য আছে দলটির। এ ছাড়া সাম্যবাদী দলের একজন মন্ত্রী রয়েছেন।
মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সুধী সমাজ
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বরাবরই সমর্থন দিয়ে আসছে দেশের আসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবী সমাজ। তবে সময় যত যাচ্ছে, দেশের বুদ্ধিজীবী ও সুধী মহলের সমর্থনও হারাচ্ছে দলটি। সুধী সমাজের অনেকেই এখন মাঠে। এরই মধ্যে তারা আলাদা একটি ফোরামও গঠন করেছে।

No comments

Powered by Blogger.