কেমন আছ মা-কান্না, হাহাকার ছাড়া আমার আর কিছু নেই-সালেমা বেগম

কান্না আর হাহাকার ছাড়া আমার আর কিছু নেই। '৭১-এর মার্চে আমার দুই ছেলেকে যুদ্ধে পাঠানোর পর বুকে যে কষ্ট, দুই চোখ ভরা যে কান্নার ভার জমেছিল, এখনো তা আছে_তেমনই আছে। এখন আমার বয়স ৮৭ বছর। এ বয়সে পেঁৗছে, মুক্তিযুদ্ধে বড় ছেলে লেফটেন্যান্ট সেলিমকে (মিরপুরের মুক্তিদাতা শহীদ লেফটেন্যান্ট সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসান) হারিয়ে কেমন আর থাকব? মোটামুটি আছি, বেঁচে আছি। বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকি।
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস আছে। হার্টের সদস্যাও আছে। শরীরে অসুখ নিয়ে, মনে বেদনার ভার নিয়ে বেঁচে আছি।
আমার চার সন্তানের তিনজনই চলে গেছে না-ফেরার দেশে। স্বামীকে হারিয়েছি, তা-ও ১৬ বছর হয়ে গেছে। এখন আমার আপন বলতে শুধু একমাত্র জীবিত ছেলে হাসান (ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ হাসান)। আমার দেখাশোনা করে হাসানই। বরিশালের বাড়িতে থাকে দু-একজন কাজের মানুষ। সারা বাড়ি ফাঁকা_খাঁ খাঁ করে। কেউ নেই। মন টানলেই, একটু শরীর খারাপ করলেই চলে আসি ঢাকায়। ছেলে ডাক্তার, ছেলের বউও ডাক্তার। তাদের হাতেই আমার চিকিৎসার ভার।
শরীর খারাপ বলেই হাসপাতালে থাকতে হয় বেশির ভাগ সময়। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে ভাবি অতীতের কথা। মনের ভেতর কত কথা জমা আছে। সব তো বলে শেষ করতে পারব না। হয়তো তা সম্ভব নয়। বড় ছেলের কথা ভাবলেই চোখের কোণে পানি আসে। বুকটা হাহাকার করে।
আমার বড় ছেলে শহীদ সেলিম শুধু মেধাবী ছাত্রই ছিল না, সে ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অ্যাথলেট; ছাত্রলীগের উজ্জ্বলতম নেতা। সে মনেপ্রাণে ছিল মুজিবভক্ত। অনেকটা তার কারণে আমাদের পুরো পরিবার বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হয়েছিল।
২৫ মার্চ যখন কেউ রাস্তায় নামার সাহস করেনি, তখন আমার দুই ছেলে তেজগাঁওয়ের সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরের পুলিশদের নিয়ে পাকিস্তানিদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। ৩১ মার্চ তারা দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেয়। জেনারেল সফিউল্লাহ নিশ্চিতভাবে স্বীকার করবেন যে, তাঁর ব্যাটালিয়নে সবচেয়ে সাহসী ও উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিল সেলিম। ১৪ এপ্রিল লালপুর যুদ্ধ থেকে সে যে যাত্রা শুরু করে, তা শেষ হয় বাংলাদেশের শেষ রণাঙ্গন মিরপুরে। মাঝে তেলিয়াপাড়া, হরষপুর, মুকুন্দপুর, ফুলগাজী, বেলোনিয়া, আখাউড়া যুদ্ধে সে অসামান্য সাহসিকতার পরিচয় দেয়। এসব কথা জেনারেল ভুঁইয়া (সুবিদ আলী ভুঁইয়া), জেনারেল মোরশেদসহ (হেলাল মোরশেদ খান) সবাই স্বীকার করবেন।
দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের 'ব্রাভো' কম্পানির কমান্ডার সেলিমকে স্বাধীনতার পর পরই রাষ্ট্রপতির গার্ড কমান্ডার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অগোচরে সেলিমকে তাঁর কম্পানি থেকে বিচ্ছিন্ন করে মেজর মঈন (মইনুল হাসান চৌধুরী) ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে নিয়ে যান। দায়িত্বপরায়ণ সেলিম ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। সেখানে বীরযোদ্ধা সেলিম যুদ্ধের শুরুতেই ডান বুকে গুলিবিদ্ধ হয়। তার পরও সে পিছু হটেনি। অধঃস্তনদের ফেলে রেখে পালিয়ে যায়নি, তাদের প্রাণ রক্ষার জন্য সে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। নিজের জামা দিয়ে সেলিম বুক বেঁধেছে, তবু পিছু হটেনি। সেই সেলিম তার সেনাদের নিয়ে নূরী মসজিদে জমায়েত হয়েছিল এবং পাকিস্তানি দলছুট সেনা ও বিহারিদের ওপর আক্রমণ করে কালাপানির ঢাল পর্যন্ত গিয়েছিল। অনেক সহযোগীকে পার করেছে সে, কিন্তু দুঃখজনক_বুকের বিশাল ক্ষত নিয়ে জলা পার হতে পারেনি সেলিম। পরে সে যখন রক্তশূন্য হয়ে নির্জীব, তখন শত্রুসেনা তাকে আবারও আঘাত করে। ওই সময় সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল তার, কিন্তু তা হয়নি। বৃষ্টিস্নাত রাতে আধো জ্যোৎস্নায় ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করে সে। তার সঙ্গী ৪১ জন সেনাসদস্য সেদিন শহীদ হয়েছিল।
তাদের রক্তের বিনিময়ে মুক্ত হলো মিরপুর (তৎকালে ঢাকার উপশহর)। মিরপুরের মুক্তিদাতা লেফটেন্যান্ট সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসান এভাবেই উৎসর্গ করল নিজের জীবন।
বিকেলের দিকে জীবিত সেনাদের নিয়ে কালাপানির ঢালের কাছে সে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ফ্যাকাসে ও ক্লান্ত। সবাইকে উৎসাহ জুগিয়েছে বিল পার হয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যেতে। কিন্তু বুকের ক্ষতের কারণে নিজে পানিতে নামতে পারেনি। ক্লান্ত শরীরটা একটি গাছের আড়ালে রেখে একটা একটা করে গুলি চালাচ্ছিল ঘাতকদের দিকে। কভার-ফায়ার করে সহযোদ্ধাদের সরে যেতে সাহায্য করছিল। সেদিন রাতে মেঘে ঢাকা চাঁদ ছিল। ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছিল। হয়তো সেলিম আমার কথা, দেশের কথা, সহযোদ্ধাদের সাহায্যের কথা ভাবছিল। না, কেউ তাকে উদ্ধার করতে যায়নি।
সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন মেজর মঈন ও কর্নেল সফিউল্লাহ। ওর প্রতীক্ষা কত দীর্ঘ হয়েছে জানি না। একসময় আকাশে ওই ফ্যাকাসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আমার চাঁদ বুঝি বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে।
এ অক্ষমতা ঢাকার জন্যই হয়তো তাঁর কমান্ডার মেজর মঈন (পরে জেনারেল) ও জেনারেল সফিউল্লাহ তাদের মিরপুরে মাটির নিচে চাপা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস কথা কয়, তাই '৯৯-এ হাড়গোড় ভেসে ওঠে। মিরপুরের মুক্তিদাতা সেলিমকে সম্মানিত করার এতটুকু উদ্যোগ নেওয়া হয়নি সামরিক বাহিনী থেকে। রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালনের জন্য, দেশপ্রেমের জন্য, নতুন দেশ ও সেনাদের সম্মানের জন্য যে তার শেষ রক্তবিন্দু দিয়েছে তার এতটুকু মূল্যায়ন হয়নি।
বঙ্গবন্ধু দেখা করে আমাকে সমবেদনা জানিয়েছিলেন। তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার খোঁজও করেননি। আমার টাকা-পয়সার দরকার নেই, বাড়িরও দরকার নেই। মৃত্যুর আগে আমি শুধু ছেলের প্রাপ্য মূল্যায়ন চাই। শেখ হাসিনার কাছে আমার এ কথা পেঁৗছাবে কি না, কে জানে।

সালেমা বেগম : বরিশাল শহরের কাউনিয়ার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসানের মা। বয়স ৮৭ বছর।
অনুলিখন : নওশাদ জামিল (নিজস্ব প্রতিবেদক)

No comments

Powered by Blogger.