দায়িত্ব যখন বাবা-মা... by মৌনতা আরওয়া

মিতু, নানুভাই ফ্যানটা একটু কমিয়ে দাও, শীত লাগছে।' নানির তৃতীয়বার বলার পর মিতু উঠে যায় ফ্যানটা বন্ধ করতে, চোখে-মুখে বিরক্তির ভাব। ইচ্ছে ছিল না ওর ফ্যানটা বন্ধ করার। নানির কারণে বন্ধ করতে হলো ফ্যানটি। রাহেলা বেগমের নতুন করে আবার নিজের জন্য কষ্ট হয়। স্বামী মারা গেছেন চার বছর। চার বছরে বুঝে গেছেন কতটা অসহায় তিনি। দুই ছেলে সরকারি চাকরি করে, ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করছে। সময় ভাগ করে তিনি থাকেন


দুই ছেলের বাসায়। কেউ বোঝে না, কিন্তু তিনি বোঝেন কতটুকু অবহেলিত হয়ে বসবাস করতে হয় গর্ভজাত সন্তানের সংসারে। তিল তিল করে গড়ে তোলা, আদর-যত্নে বড় করে তোলা সন্তানদের কাছে পুরনো আসবাবের মতোই আছেন তিনি। এখন ঢাকায় মেয়ের বাসায়। চিকিৎসা করাতে এসেছেন। চাকরিজীবী এক সময়ের অতি আদরের মেয়ের মায়ের প্রতি যথেষ্ট যত্ন আছে, তবুও তিনি বুঝতে পারছেন স্বামী-সন্তানসহ মেয়ের সংসারে তার উপস্থিতি একটু সমস্যার সৃষ্টি করছে। আবার তিনি ভাগের মা হয়ে ফিরবেন দুই ছেলের কাছে। সন্তানরা টেলিফোনে কিংবা পারিবারিক আলোচনায় মাঝে মাঝে যখন তর্কাতর্কি করে, নিজেকে তখন বোবা-সর্বংসহা পশুর মতো মনে হয়। এরা তা বোঝে না। বোঝার চেষ্টার ইচ্ছেটুকুও ওদের নেই।
২.
হাসিনা খাতুন, বয়স ৭০। থাকতেন ময়মনসিংহের ভালুকার একটি গ্রামে। পাঁচ ছেলে। মোটামুটি অবস্থাপন্ন হয়ে সবাই সংসার করছে। গ্রামের খোলামেলা পরিবেশ ছেড়ে আজ তিনি বদ্ধ ফ্ল্যাটে। অসুস্থ শরীর নিয়ে একা সামলাতে পারছেন না, বড় ছেলের বাসায় থাকছেন এখন। জীবনধারণ এবং ওষুধাদির খরচ একেক মাসে একেক সন্তান দেন। মাঝে মাঝে হাসিনা খাতুনের মনে হয় সন্তানদের দয়ার ওপর বেঁচে আছেন তিনি। যে সন্তানদের দশ মাস গর্ভে ধারণ করেছেন, নিজেরা হাড়চূর্ণ কষ্ট করে, নিজেদের চিন্তা বাদ দিয়ে ওদের সুখ-আহ্লাদের কথা ভেবেছেন, আজ তাদের দয়ার ওপরই বেঁচে আছেন। বড় ছেলের বউটা মাঝে মাঝে বিরক্তিতে বলে 'ও কি একাই আপনার সন্তান? আর কোনো ছেলেমেয়ে আপনার নেই? ওরা কেন নিজেদের বাসায় নিয়ে রাখে না। তাহলে আমিও টাকা পাঠিয়ে রেহাই পেতাম।' নিজেদের সংসার নিয়ে সবাই ব্যস্ত। দেখা যায় কেউ একা হাসিনা খাতুনের পুরো দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। পারলে কেউ হাত নেয়, কেউ পা, কেউ মাথা। আক্ষেপ করে উনিও বলেন, আমাকে যদি ভাগ করা যেত তাহলে বোধহয় ভালো হতো। সন্তানদের ঝামেলা অনেকটা কম হতো।

"আমার ছেলেমেয়েরা একটা সময় মফস্বল শহরটাতেই আমাদের কোলে-পিঠে মানুষ হয়েছে। তারা এখন দেশের নানা জায়গায় কর্মক্ষেত্রের কারণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমরা দুইজন একা একা বাসায় থাকি। বয়সের কারণে শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা ধরনের রোগ। চলাচলেও কষ্ট। এখানে দেখার মতো নিকটাত্মীয় তেমন কেউ নেই। নিরাপত্তার অভাব, কখন কী ঘটে যায় এসব নিয়ে আমার তিন সন্তান খুব ভাবনার মধ্যে ছিল। মাঝখানে ওরা আমাদের নিয়ে যেতে চায় নিজেদের কাছে। কিন্তু ওরা ঢাকা শহরে থাকে। বাসা ছোট। আমাদের নিয়ে গেলে কারও কারও আবার বাসা বদল করতে হবে। বড় বাসা নিতে হবে। এসব নানা চিন্তায় ওরা ভাবে আমাদের দু'জনকে দু'বাসায় রাখবে। আমি মেয়ের বাসায় থাকব আর ওদের বাবা বড় ছেলের বাসায়। প্রথমে ভেবেছিলাম যাব। পরবর্তীতে দেখলাম বিয়ের পর থেকে সেই যে দু'জন একসঙ্গে হয়েছি। এখন আর আলাদা থাকতে পারব না। জীবনটা আর কয়দিনের? এর মধ্যেই যদি ওপারের ডাক আসে? এ শেষ সময়টায় ওদের বাবার কাছের মানুষ বলতে আমি। আমার কাছের মানুষ বলতে ওর বাবা। দু'জনকে যদি আলাদা বাসায় রাখে তাহলে কি আমরা ভালো থাকব?" টলটল চোখে মনের দুঃখ এভাবেই শেয়ার করলেন এক মা মেহেরুন্নেছা। জীবনের এ শেষ সময়টায় জীবনসঙ্গী-ই সবচেয়ে আপনজন। তাই তিনি এবং তার বৃদ্ধ স্বামী আলাদা হননি। হাজারো কষ্ট সহ্য করে তারা একজন আরেকজনের পাশেই থাকতে চেয়েছেন। হোক না নিজেদের জীবন-মরণ সমস্যা। তাদের জন্য সন্তানদের কোনো ঝামেলা হোক, সংসারে সমস্যা হোক বাবা-মা তা চান না।
কথা বলেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ডাইনিংয়ে কর্মরত দুই বৃদ্ধা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর সঙ্গে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর নিয়েও যারা এখন গুটুর গুটুর করে শান্ত পদক্ষেপে কাজ করে যাচ্ছেন। নিজেদের সন্তানদের নিত্য অভাব-অনটনের সংসারে একরকম ভারবাহী-ই তারা। ভাগবাটোয়ারা কিংবা সন্তানের সংসারে চরম অবহেলিত হয়ে তারা আজ এ কাজ করছেন। শেষ বয়সে এসেও নিজের ব্যয়ভার নিজে বহন করছেন। কিন্তু জীবনের ক্লান্ত বিকেলে ক'জনেরই বা এমন সামর্থ্য আছে নিজেকে বয়ে নিয়ে চলার?
সব কষ্ট সহ্য করে বাবা-মা সন্তানদের প্রতিপালন করেন। বৃদ্ধ হয়ে গেলে সন্তানই তাদের দেখাশোনা করবে এমনই হয়ে আসছে। চিরন্তন এ নিয়মটিতে এখন আমরা উদাসীন হয়ে যাচ্ছি। যে মা একহাতে সামলাতেন তার সব সন্তানদের, সেই মায়ের সব সন্তানরা মিলে এক মা-কে সামলাতে হিমশিম খান। মায়ের আন্তরিকতার শূন্য ভাগ তাদের কাছে থাকে না। বৃদ্ধ বয়সে এসে অনেকে তাই খুঁজে বৃদ্ধাশ্রম। সন্তানের মুখপানে চেয়ে বাবা-মা সব করতে পারেন। বৃদ্ধ বয়সে তাই খড়কুটোর মতো সন্তানের সংসারটাকে আঁকড়ে বাঁচতে চান। চারদিকের হীনতার আকর্ষণ থেকে ক'জন-ই বা আমরা নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি? মা তো ভাগাভাগির নয়। মা, মা-ই। বাবাও তেমন। আমাদের জন্য যারা সারাটা জীবন ত্যাগ-ই করে গেলেন, বৃদ্ধ বয়সে কেন তবে আমাদের এমন মুখ ফিরিয়ে নেওয়া?

No comments

Powered by Blogger.