বখাটেরা হত্যা করল শাবির দুই ছাত্রকে

বিজয় দিবসে নৌকাভ্রমণ করতে গিয়ে বখাটেদের হামলায় নির্মমভাবে খুন হয়েছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) দুই ছাত্র। এ ঘটনায় হাহাকারের পাশাপাশি ক্ষোভে ফুঁসছেন শাবির ছাত্রছাত্রীরা। আট বন্ধু মিলে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সুরমার শাখা নদী চেঙ্গেরখালে নৌকাভ্রমণের শেষ পর্যায়ে একদল বখাটে আরেকটি নৌকায় এসে তাঁদের ওপর চড়াও হয়। বখাটেরা তাঁদের টাকাপয়সা, মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এবং দলের তিন
ছাত্রীকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। ছাত্ররা প্রতিরোধ করলে তাঁদের বেদম পিটিয়ে তিনজনকে পানিতে ফেলে দেয়। গতকাল শনিবার সকালে চেঙ্গেরখাল থেকে দীপঙ্কর ঘোষ অনিক ও খায়রুল কবিরের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁরা দুজনই কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। অন্য ছাত্র আহত অবস্থায় রাতেই ক্যাম্পাসে ফিরতে সক্ষম হন।
ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গতকাল সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক সাত ঘণ্টা অবরোধ ও গাড়ি ভাঙচুর করেন। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ভবনে ব্যাপক ভাঙচুরও করা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে দুই ছাত্রের লাশ সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে নিয়ে আসা হলে বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক সহপাঠীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ক্যাম্পাসে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
পুলিশ গতকাল সকাল ৭টা থেকে ১০টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে চেঙ্গেরখালের নোয়াকান্দি এলাকা থেকে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় তাঁদের লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ ছাত্রদের বহনকারী নৌকার মালিক ও মাঝিকে গ্রেপ্তার করেছে।

বিজয় আনন্দে বিষাদ
নিহতদের সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের সাত শিক্ষার্থী অনিক, খায়রুল, জোসেফ, সাইদ ইবনে সাদ, সুপর্ণা, নীলা, কণা এবং অনিকের ফুপাতো ভাই ঢাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র রাজীব মিলে বিজয় দিবসের দিন বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আট কিলোমিটার দূরে বাদাঘাট এলাকায় যান। ঘাট থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করে ভ্রমণে বের হন। ভ্রমণ শেষে ফেরার পথে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ৮-১০ জনের একটি বখাটে দল পেছন থেকে অন্য একটি নৌকায় এসে তাঁদের গতিরোধ করে। বখাটেরা শিক্ষার্থীদের টাকাপয়সা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এবং তাঁদের মারধর করতে থাকে। এক পর্যায়ে তিন ছাত্রীকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে ছাত্ররা বাধা দেন। বখাটেরা তখন ছেলেদের বেধড়ক পেটাতে থাকে। অনিক, খায়রুল ও রাজীবকে পিটিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। তিন ছাত্রীসহ জোসেফ ও সাদ পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। রাতে রাজীবও আহত অবস্থায় ক্যম্পাসে ফিরে আসেন।
রংপুুরের সেনপাড়ার বাসিন্দা অনিক একুশে টেলিভিশনের সিনিয়র মার্কেটিং এঙ্িিকউটিভ দীপক ঘোষের ছেলে। খায়রুল ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার উলাইল গ্রামের প্রয়াত মো. সিরাজুল হকের ছেলে। অনিক সিলেট শহরের পাঠানটুলায় একটি মেসে এবং খায়রুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের ১/সি জালালি অ্যাপার্টমেন্টে অন্য একটি মেসে থাকতেন। খবর পেয়ে অনিকের বাবা এবং খায়রুলের ভাই মরদেহ নিতে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভলিবল মাঠে জানাজা শেষে তাঁদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
উত্তাল শাবি : ওই জঘন্য হামলা ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল সারাদিনই শাবি ক্যাম্পাস উত্তাল ছিল। দফায় দফায় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিরা বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। দুই ছাত্রের লাশ উদ্ধারের খবরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থান নেন। তাঁরা ফটকের সামনে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করেন। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ভবনেও ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়।
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সালেহ উদ্দিন, সিলেটের মেয়র বদরউদ্দিন আহমেদ কামরান শিক্ষার্থীদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেওয়ার পর শিক্ষার্থীরা বেলা আড়াইটার দিকে অবরোধ তুলে নেন।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, '২৪ ঘণ্টার মধ্যে দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হবে বলে প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে। তা না হলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমি নিজেও রাজপথে নামব।'
দুই ছাত্রের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার দাবি তুলে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনগুলোয় ব্যাপক ভাঙচুর করেন। এ সময় ছাত্ররা পথচারীদের ওপরও হামলা চালান। তাঁরা একটি বাস ভাঙচুর করেন এবং যাত্রীদের ওপর চড়াও হন। খবর সংগ্রহ ও ছবি তুলতে গেলে শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালান এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। শিক্ষার্থীদের অনেকে গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর অনাস্থা জানিয়ে তাঁর বিরুদ্ধেও স্লোগান দেন। দাবি মানা না হলে তাঁরা আমরণ অনশন করবেন বলেও ঘোষণা দেন।
তিন দিনের শোক : বখাটেদের হামলায় দুই ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছেন। আজ থেকে আগামী তিন দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস বা পরীক্ষা হবে না। আজ রবিবার ক্যাম্পাসে শোকযাত্রা ও শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে।
তদন্ত কমিটি গঠন : ঘটনা তদন্তের জন্য কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অর্থনীতি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ হাসানুজ্জামান শ্যামল ও একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সায়ন চক্রবর্তী। কমিটিকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনার প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। শাবির প্রশাসনের পক্ষে রেজিস্ট্রার ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন।
বেঁচে যাওয়া সাদ বলেন : ভ্রমণ দলটিতে থাকা সাইদ ইবনে সাদ বলেন, 'আমরা নৌকাভ্রমণ করতে বাধাঘাট যাই। সেখানে নৌকা ভাড়া করে ঘুরছিলাম। হঠাৎ মাঝি নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দেন। কিছুক্ষণ পর ইঞ্জিন চালু হওয়ার পরপরই পেছন থেকে একটি নৌকা করে ৮-১০ জন এসে আমাদের মারধর করতে শুরু করে। তারা আমাদের সঙ্গে থাকা মেয়েদের নির্যাতন করতে চাইলে আমরা বাধা দিই। এ সময় অনিক ও খায়রুল পানিতে পড়ে যায়। পরে মাঝি আমাদের নিয়ে চলে আসে।'
মাঝির বক্তব্য : আটক নৌকার মাঝি চামাউরা গ্রামের গুলজার আহমদ (৪০) জানান, সন্ধ্যা ৬টার দিকে ছয় ছাত্র ও তিন ছাত্রী নৌকা ঘাটে আসেন। তাঁরা ঘণ্টাখানেক বেড়ানোর কথা বলে তাঁর নৌকা ভাড়া করেন। তিনি তাঁদের নিয়ে বাদাঘাট থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে নোয়াকান্দির একটি নির্জন এলাকায় যান। সেখানে শিক্ষার্থীরা তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে পাড়ে ওঠেন। আধ ঘণ্টার পরও যখন তাঁরা ফিরছিলেন না, তখন তিনি নিজে গিয়ে তাঁদের ডেকে আনেন। নৌকা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ৮-১০ জনের বখাটে দল তাঁদের ওপর হামলা চালায়। বখাটেদের হামলায় তিন ছাত্র নৌকা থেকে নদীতে পড়ে যায়। বখাটেরা বাকি শিক্ষার্থীদের এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকে। বখাটেরা নৌকা থেকে তিন ছাত্রীকে জোর করে তুলে নিতে চায়। এ সময় তিনি ও শিক্ষার্থীরা মিলে বখাটেদের প্রতিহত করেন। এরপর নদীতে পড়ে যাওয়া তিন ছাত্রকে রেখেই তিনি বাকিদের নিয়ে বাদাঘাট চলে আসেন।
লাশ মিলল সকালে : বখাটেদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে প্রথমে আহত রাজীবকে নিয়ে ওসমানী হাসপাতালে যাওয়া হয়। ঘটনাটি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুস, প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক হিমাদ্রি শেখর রায় ও সায়েন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক ইয়াসমিন হককে জানানো হয়। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জালালাবাদ থানায় ও ফায়ার সার্ভিসকে জানায়। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা তিন ছাত্র যেখানে নদীতে গিয়েছিলেন, সেখানে রাতভর তল্লাশি চালায়। গতকাল সকাল ৭টা থেকে ১০টার মধ্যে জেলেদের সহযোগিতায় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে অনিক ও খায়রুলের লাশ উদ্ধার করে। এ সময় চেঙ্গেরখালের দুই ধারে অসংখ্য মানুষ ভিড় করে। খবর পেয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার অমূল্য ভূষণ বড়ুয়াসহ প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান।
দুজন গ্রেপ্তার : জালালাবাদ থানার ওসি মো. সেলিম হোসেন জানান, বাদাঘাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকা সন্দেহে ছাত্রদের নৌকার মালিক তারেক ও মাঝি গুলজারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্ধার করা দুই ছাত্রের লাশের শরীরে লাঠির আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রীর নিন্দা : শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি সিলেট সিটির মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ উদ্দিন, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।
স্বপ্নের শুরুতে জীবনের শেষ

No comments

Powered by Blogger.