ডারবান সম্মেলন-অনেক কার্বন নিঃসরণ হলো বটে... by তারেক শামসুর রেহমান

ডারবান সম্মেলনে বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফার্স্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া গেছে মাত্র আড়াই বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সেখান থেকে পেয়েছে ১৩০ মিলিয়ন ডলার। সার্ক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ঐক্যবদ্ধভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যাগুলো আমরা তুলে ধরব। কিন্তু ডারবানে তা হয়নি আরও একটি ব্যর্থ জলবায়ু সম্মেলন হয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে। কপ-১৭ নামে পরিচিত এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল ১৯৫টি দেশ।


বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে জাপানের প্রাচীন রাজধানী কিয়োটোতে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একটি চুক্তি করেছিলেন। ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। এ কারণেই নতুন একটি চুক্তির প্রয়োজনীয়তা ছিল অনেক বেশি। বিশেষ করে সাগরঘেঁষা দেশগুলোর জন্য ডারবান সম্মেলন ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেখা গেল উন্নত তথা শিল্পোন্নত দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণে ডারবানেও কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস করার ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট চুক্তিতে উপনীত হওয়া সম্ভব হলো না। গত কয়েক বছর ধরেই কপ (কমিটি অব দ্য পার্টিস) সম্মেলন হয়ে আসছে। প্রতিটি সম্মেলনের আগেই সম্মেলন নিয়ে অনেক আশার কথা শোনানো হয়। কিন্তু সম্মেলন শেষে দেখা যায়, বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাসের ব্যাপারে অগ্রগতি হয়েছে অতি সামান্যই। অথচ এসব সম্মেলনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ প্রায় দু'সপ্তাহ ধরে তারা চেষ্টা করেন একটি চুক্তিতে উপনীত হতে। মজার কথা, সম্মেলনে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হ্রাসের কথা জোরেশোরে উচ্চারিত হলেও, সম্মেলনে অংশ নেওয়া হাজার হাজার প্রতিনিধির আসা-যাওয়াতে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়। ডারবান সম্মেলন শেষে যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ কমাতে একটি সর্বসম্মত চুক্তি করতে বিশ্বের সব দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। আগামী বছর থেকে এ সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হবে এবং ২০২০ সাল থেকে ওই চুক্তিটি কার্যকর হবে। তবে একটি গ্রিন ফান্ড গঠনের ব্যাপারে শিল্পোন্নত দেশগুলো রাজি হয়েছে। এই ফান্ডের পরিমাণ হবে ১০০ বিলিয়ন ডলার। ৪০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে এই ফান্ড যাত্রা শুরু করবে। বিশ্বব্যাংক এই ফান্ডের ব্যবস্থাপনার তদারক করবে।
ডারবান সম্মেলনের পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, প্রতি বছর এ ধরনের সম্মেলন করে শেষ পর্যন্ত কি বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করা সম্ভব হবে? বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তাই কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবেই। ইতিমধ্যে জাপান, কানাডা ও রাশিয়া কিয়োটো-পরবর্তী আলোচনা থেকে বেরিয়ে গেছে। সুতরাং বোঝাই যায়, এক ধরনের হতাশা এসে গেছে। আসলে বিশ্বের দেশগুলো এখন বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একেক গ্রুপের একেক এজেন্ডা। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি, তার মাঝে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেক্স-১-এ অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগ এই দেশগুলোর। অথচ লোকসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ১৯ ভাগ। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশি; শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ ৭৭-এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ, জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ। কিন্তু কার্বন উদগিরণ করে ৪২ ভাগ। আবার সাগরপারের দেশগুলো, যারা বিশ্বের জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ১ ভাগ। তাদের দাবি, ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো, যারা রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ্ব জনগোষ্ঠীর ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ ভাগ তাদের। আর মাত্র ৪ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ ভাগ, জিডিপির ৩০ ভাগ তাদের। অথচ জনসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ৫ ভাগ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ ভাগ ও জনসংখ্যার ৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ ভাগ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ ভাগ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ ভাগ তাদের। প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটাকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। অর্থাৎ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উদগিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে এই হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিত_ এটা মোটামুটি সবাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে, সে বিষয়ে কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সঙ্গে ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়, সে কারণে এ দুটো দেশের কাছ থেকে 'কমিটমেন্ট' আশা করেছিল বিশ্ব। কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিল, ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চাইতে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল, তারা ১৭ ভাগ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২ দশমিক ৮৫ টন, আর ভারতের ১ দশমিক ৮ টন। চীন ও ভারত দুটো দেশই বড় অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে এই শতাব্দীতে। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় তখন ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ। ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। তবে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ ভাগ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়_ তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কেননা, প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। আর তাতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সব দেশকে ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিংসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজ-কলমে থেকে গিয়েছিল।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে ক'টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে গেলে উপকূলের মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশে প্রতি ৭ জনে ১ জন উদ্বাস্তু হবে। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল।
ডারবান সম্মেলনে বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফার্স্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া গেছে মাত্র আড়াই বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সেখান থেকে পেয়েছে ১৩০ মিলিয়ন ডলার। সার্ক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ঐক্যবদ্ধভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যাগুলো আমরা তুলে ধরব। কিন্তু ডারবানে তা হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারত একই ফোরামে ছিল না। একটি আইনি বাধ্যবাধকতার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রযুক্তি হস্তান্তর সম্পর্কেও কোনো সমঝোতা হয়নি।
কপ সম্মেলন এলেই বড় বড় কথা বলা হয়। কয়েক টন কার্বন নিঃসরণ করে সম্মেলন 'অনেক আশার কথা শুনিয়ে' শেষ হয় বটে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয় খুব কমই। আগে সমস্যা ছিল উন্নত বিশ্বকে নিয়ে। এখন চীন ও ভারতও একটি সমস্যা। তাদের যুক্তি, নিঃসরণের পরিমাণ হ্রাস করলে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। তাতে বাড়বে দরিদ্রতা। এই যুক্তি ফেলে দেওয়ার নয়। ফলে কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেলই।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman@aol.com

No comments

Powered by Blogger.