গেরিলার রাজনৈতিক তাৎপর্য ও শিল্পমূল্য by হায়দার আকবর খান রনো

স্বাধীনতার ৪০ বছর পর হলেও 'গেরিলা' নামের অসাধারণ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। এই চলচ্চিত্রটির নান্দনিক সৌন্দর্য ও শিল্পগুণ অসামান্য। একই সঙ্গে এমন চলচ্চিত্রের রাজনৈতিক তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি। বিশেষ করে এখন যখন নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধকে বিস্মৃত ও বিকৃত করার অপচেষ্টা চলছে, তখন এই চলচ্চিত্রের বহুল প্রচার ও প্রদর্শনী খুবই দরকার বলে মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধারাকে যারা সত্যিকার অর্থে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়,


তেমন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও সংস্থাগুলোর উচিত দেশের সর্বত্র এই চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী সংগঠিত করা। এই দায়িত্ব নেওয়া উচিত রাজনৈতিক কর্তব্য হিসেবেই। চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ (বাচ্চু) নিজে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন। আবার নাট্যশিল্পী ও পরিচালক হিসেবেও প্রতিভাবান। ব্যক্তিগত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও শৈল্পিক প্রতিভা_এই দুয়ের সংমিশ্রণের ফলে আমরা যা পেয়েছি, তা এক অনবদ্য সৃষ্টি।
এর আগেও অনেক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা, মঞ্চনাটক, টিভিনাটক হয়েছে; গল্প, উপন্যাস, কবিতাও আছে। তবে যতটা হওয়া দরকার ছিল, ততটা হয়নি। এটা আমার অভিমত। এর মধ্যে অবশ্যই কয়েকটা বেশ উঁচুমানের, যথেষ্ট উৎকৃষ্ট। কিন্তু বলতে বাধা নেই যে বেশির ভাগ রচনা তেমন মান অর্জন করতে পারেনি। উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিকতাকে একসঙ্গে ধারণ করা বোধহয় এর আগে সম্ভব হয়নি। গ্রাম ও শহরের ভিন্ন ভিন্ন চিত্র, অবরুদ্ধ শহর ও মুক্তাঞ্চল, একদিকে নিষ্ঠুর বর্বরতা এবং অন্যদিকে সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধ, সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ও ভূমিকা, সবটা একসঙ্গে এর আগে এভাবে আসেনি, যা 'গেরিলা'য় এসেছে। সর্বোপরি যুদ্ধে নারীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রায় অনুচ্চারিত থেকেছে সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে। মেয়েরা ধর্ষিত হয়েছেন, এটা বহুবার দেখানো হয়েছে অনেক চলচ্চিত্রের নাটকে বা গল্পে। কিন্তু মেয়েরা যে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তেমন ঘটনা কোনো গল্প, উপন্যাস, নাটক বা চলচ্চিত্রে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আত্মকথায় খুব একটা আছে বলে আমার জানা নেই। সেদিক থেকে 'গেরিলা' চলচ্চিত্রটি ব্যতিক্রম। এখানে একজন নারী চরিত্রই মুখ্য। দ্বিতীয়ত, এই চলচ্চিত্রে অবরুদ্ধ ঢাকা শহর ও আধামুক্ত গ্রামাঞ্চলের চিত্র_দুটোই আছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিকতার রূপ তুলে ধরা খুব সহজ কাজ নয়। কারণ মহাকাব্যের মতোই এর বিশালত্ব ও বৈচিত্র্য। তবু নাসিরউদ্দীন ইউসুফ সামগ্রিকতার অনেকটা কাছাকাছি যেতে পেরেছেন। চলচ্চিত্রটি আর্ট হিসেবেও অতি উঁচুমানের। তাই এটি হয়ে উঠেছে এক অনবদ্য সৃষ্টি।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক হরিপদ দত্ত 'গেরিলা' চলচ্চিত্রটিকে মহাকাব্যরূপে বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, চলচ্চিত্রটি মহাকাব্য। আমার মনে হয়, তিনি বাড়িয়ে কিছু বলেননি। তিনি সঠিকভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে মহাকাব্য বলে অভিহিত করেছেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে রয়েছে একদিকে নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, ধ্বংস, মৃত্যু যার তুলনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল, যা হিটলার বা নাদির শাহর সঙ্গেই তুলনীয় (বা তাদেরও হার মানায়); অন্যদিকে রয়েছে অসম সাহসী যুদ্ধ, আত্মত্যাগ, বীরত্ব, মনুষ্যত্বের মহত্তম প্রকাশ, গণমানুষের সম্মিলিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ ও বিজয়ের উল্লাস। বীর রস, করুণ রস, আনন্দ রস_বহু বিপরীত বৈচিত্র্যের যে ধরনের সমাবেশ ঘটে থাকে মহাকাব্যে, তাই-ই যেন আমরা দেখতে পেয়েছি ১৯৭১ সালে। হরিপদ দত্ত লিখেছেন, 'সাহিত্যের বাইরে বাঙালির একমাত্র মহাকাব্য হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বীরত্ব, সর্বোচ্চ ত্যাগ, মৃত্যু, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, ঈর্ষা, বীভৎসতা, শোক, বিলাপ, মানবতার বিপর্যয়, ভয়ংকর যুদ্ধ, বিজয়, স্বদেশপ্রেম, উল্লাস, ব্যক্তিমানুষের বাইরের ও ভেতরের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি ব্যঞ্জনা পাশাপাশি কিংবা একাকার হয়ে মহাকাব্য শিল্প হয়ে ওঠে। এমনই এক জটিল রাজনৈতিক মহাকাব্য নির্মাণের সাহস দেখিয়েছেন বাঙালি চলচ্চিত্রকার নাসিরউদ্দীন ইউসুফ।'
আমার নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় এ কারণে যে এমন মহাকাব্যিক ঘটনা, জাতির জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। নিজেকে আরো সৌভাগ্যবান মনে হয় এ কারণে যে সেই সময় আমার বয়স ছিল ২৮-২৯ বছর। যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। আরো অনেক তরুণ-যুবকের মতো আমিও যুদ্ধে গেছি। তবে নাসিরউদ্দীন ইউসুফ অথবা আমার ছোট ভাই হায়দার আনোয়ার খান জুনোর মতো সরাসরি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ আমি করিনি। নাসিরউদ্দীন ইউসুফ তখন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তাই বয়সে আমার চেয়ে বেশ কম। আমার ভূমিকা ছিল সংগঠকের, যদিও অস্ত্র কাঁধে নিয়ে মাঝেমধ্যে ছোটাছুটি করতে হয়েছে। আমাদের সংগঠনের যে ১৪টি মুক্ত-আধামুক্ত গেরিলা ঘাঁটি এলাকা ছিল, তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, রাজনৈতিক নির্দেশ দেওয়া ইত্যাদি কাজ করতে হয়েছিল, হয় ঢাকার নিকটস্থ শিবপুরের ঘাঁটি অঞ্চল থেকে অথবা ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে। অবরুদ্ধ ঢাকা শহর দেখেছি দুই দিনের জন্য, মে মাসে। তখনো ঢাকায় গেরিলা তৎপরতা শুরু হয়নি। মুক্তাঞ্চলে থেকেছি। রাতে মুক্ত, দিনে মিলিটারির আকস্মিক আক্রমণ হচ্ছে, এমন এলাকাও দেখেছি। খুন, ধর্ষণ, লুট ও অগি্নসংযোগের ঘটনাও খুব কাছ থেকে দেখেছি বা শুনেছি। খুব কাছ থেকে দেখেছি অ্যামবুশ করে থাকা মুক্তিসেনাদের, দেখেছি তুমুল যুদ্ধ, দেখেছি রক্তাক্ত দেহে তরুণকে, যিনি স্বাধীনতার জন্য রণাঙ্গনে জীবন বিসর্জন করেছেন। এই রকম অভিজ্ঞতা আমার বয়সী অনেকেরই আছে। এই অভিজ্ঞতা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা খুবই দরকার। সেই কাজটি করেছে 'গেরিলা' চলচ্চিত্র।
যুদ্ধ কি কেবল অস্ত্রধারী যোদ্ধারা করেছেন? যে বৃদ্ধ মা বুকের সবটুকু স্নেহ ঢেলে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁর অবদান কি কম? সাধারণ মানুষের অসামান্য সমর্থন ও সহযোগিতা এবং সাহস ও ঝুঁকি নেওয়ার ঘটনা যেসব দেখেছি, তা কেবল অমন এক বিশেষ ঐতিহাসিক সময়েই সম্ভব ছিল। আমার দেখা সেসব ছবি, আমার সঞ্চয়ের অভিজ্ঞতাগুলো যেন ওঠে আসছিল সিনেমার পর্দায়। আমি যখন হলে বসে ছবিটি দেখছিলাম, তখন সেসব পুরনো স্মৃতিই ভেসে আসছিল। এত বড় মুক্তিযুদ্ধকে মাত্র আড়াই ঘণ্টায় ফুটিয়ে তোলা সহজ কাজ নয়। নিঃসন্দেহে খুব বড় কাজ। শুধু বড় নয়, আমি বলব, মহৎ_রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা ও শৈল্পিক উৎকর্ষ_উভয় বিচারেই। পরিচালক লিখেছেন, চলচ্চিত্রে মুক্তিযোদ্ধা খোকনের মৃত্যু ও মুক্তিযোদ্ধা বোনের (বিলকিস) আর্তচিৎকার হলে দর্শকের সারিতে বসে দেখে তাঁর মনে পড়েছে নিজের ছোট বোনের কথা, বোনের মৃত্যুর কথা। অশ্রুসিক্ত হয়েছে তাঁর চোখ। স্মৃতিকে বহন করতে হয় জীবিতদের। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের চেনা-পরিচিতের অনেকেরই প্রাণ গেছে। আমার এক খালাতো বোন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছিলেন। আমার মা গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। এই মৃত্যুসংবাদ জেনেছি স্বাধীনতার পর ঢাকায় এসে। এমন ঘটনা বহু সংসারেই হয়েছে। 'গেরিলা' দেখতে দেখতে সেসব বেদনাময় স্মৃতি ভেসে উঠছিল। এই ছবি দেখে আমার মতো অথবা স্বয়ং পরিচালকের মতো আর কতজনের মনে দুঃখ-বেদনার স্মৃতি ভেসে উঠবে, তা কে বলতে পারে? 'গেরিলা' দেখতে দেখতে আমরা যেন পেছন ফিরে সেই স্বদেশকেই দেখব, যে স্বদেশ এক দিন লাঞ্ছিত হয়েছিল, আবার মুক্তির স্বপ্নে ও সংগ্রামে ভাস্বর হয়ে উঠেছিল। 'গেরিলা' চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে ইতিহাস, যে ইতিহাস নতুন প্রজন্ম কেবল গল্পের আকারে শুনেছে, চোখে দেখেনি। এবার দেখুক, যদিও চলচ্চিত্রের পর্দায়।
পরিচালক নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ইতিহাসকে নির্ভুলভাবে রেখেছেন, নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত করেছেন সেই সময়কে। অনেক চরিত্র, অনেক নাম আছে, সেগুলো কাল্পনিক নয়, যাঁদের অনেকে ঢাকায় গেরিলা অ্যাকশনে অংশ নিয়েছেন, অনেকে শহীদও হয়েছেন (যেমন রুমী)। সংগীতশিল্পী আলতাফ মাহমুদ তো সত্যিকারের চরিত্র। তাঁর মৃত্যুটি ছিল বীরের মৃত্যু। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ারও কাল্পনিক চরিত্র নয়, যিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলেন এবং শহীদ হয়েছিলেন। এক জায়গায় ডাক্তার আজিজ ও ডাক্তার সুলতানা এবং তাঁদের ক্লিনিকের নাম শোনা যায়। বাস্তবে স্বামী-স্ত্রী এ দুই ডাক্তার তাঁদের ক্লিনিকে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়েছেন, চিকিৎসাসেবাও দিয়েছেন। একটা ঘটনার কথা বলি। একবার শিবপুর থেকে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা শেখ কাদেরকে ডাক্তার দম্পতির কাছে পাঠানো হয়েছিল কিছু ওষুধ আনতে যুদ্ধের প্রয়োজনে। শেখ কাদের যখন পলি ক্লিনিকের ভেতরে ঠিক তখন গোটা পাড়াটা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘিরে ফেলে। তারা প্রতিটি বাড়িতে ঢুকে তরুণ-যুবক পেলেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ডা. সুলতানার উপস্থিত বুদ্ধিতে সেদিন শেখ কাদের বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি শেখ কাদেরকে অপারেশন থিয়েটারে অপারেশনের পোশাক পরিয়ে অজ্ঞান করে রেখেছিলেন এবং নিজেও অপারেশনের যন্ত্রপাতি হাতে নিয়ে এমন ভান করছিলেন, যেন এখনই অপারেশন করবেন। পাকিস্তানি দস্যুরা অপারেশন থিয়েটারে হানা দিয়েছিল এবং অজ্ঞান রোগী দেখে ফিরে চলে যায়।
সৈয়দ শামসুল হকের লেখা উপন্যাস 'নিষিদ্ধ লোবান'-এর কিছুটা কাহিনীর ভিত্তিতে এই ছবিটি নির্মিত হলেও এটা বলতে হয় যে নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর হাতে তৈরি এই চলচ্চিত্রটি একটি নতুন সৃষ্টি। এর মধ্যে ইতিহাস আছে, বাস্তবের ছোঁয়া আছে এবং নান্দনিক উৎকর্ষ আছে। নৃশংসতার দৃশ্য আছে, জবাই করে হত্যা করার ঘটনা আছে, হাতের আঙুল কেটে ফেলার দৃশ্য আছে (আঙুল কাটার দৃশ্য হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র 'আগুনের পরশমণি'তেও আছে)। পানিতে ভাসমান লাশের মিছিল_এগুলো কোনোটাই বানানো বা অতিরঞ্জিত নয়। মনে পড়ে, ১৯৭১ সালের মে মাসে আমি ও আমার এক সহকর্মী আতিকুর রহমান সালু মিরপুরের পুরনো ব্রিজটি (সে ব্রিজটি এখন আর নেই) হেঁটে পার হচ্ছিলাম। নিচে পানিতে একাধিক লাশ ভাসতে দেখেছি। কাক ঠোকরাচ্ছিল লাশগুলোকে। আর মুক্তিযোদ্ধারা সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, একটি খণ্ডযুদ্ধে বিজয়ের পর 'জয় বাংলা' বলে আনন্দে চিৎকরা করছেন, এমন দৃশ্য অনেক আছে। ছবিটিতে যুদ্ধের দৃশ্য তো থাকবেই। রাইফেল কাঁধে এক মুক্তিযোদ্ধা এক বৃদ্ধাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন, এ ধরনের দৃশ্য মুক্তিযুদ্ধের মানবিক চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলে। এটা কোনো কনভেনশনাল যুদ্ধ নয়। এটা ছিল জনগণের যুদ্ধ। আমাদের দিক থেকে এটা ছিল ন্যায় যুদ্ধ, মানবিক যুদ্ধ। মানবতার মুক্তির জন্য যুদ্ধ। তাই পরিচালক এক ঝলকে বিশ্বের কয়েকজন মহানায়কের ছবি তুলে ধরেছেন, যাঁরা মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী সূর্য সেন ও প্রীতিলতার ছবি আছে। এর দ্বারা পরিচালক বোঝাতে চেয়েছেন যে ব্রিটিশ আমল থেকে যে স্বাধীনতার সংগ্রাম চলে আসছে, তারই ধারাবাহিকতায় এসেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বলাই বাহুল্য, একাত্তরের যুদ্ধ ও তার পটভূমি তুলে ধরতে হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ও নাম তো আসবেই। এ ছাড়া এক ঝলকে এসেছে মওলানা ভাসানীর ছবি। বাঙালির কবি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ছবিও এসেছে। এই দুই কবিই মানবমুক্তির কথা বলেছেন, যাঁদের গান আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে সংকীর্ণ পরিসরে না দেখে বিশ্ব মানবমুক্তির সংগ্রামের অংশ হিসেবেও দেখা যায়। তাই দেখি এক ঝলকে তুলে ধরা হয়েছে কাল মার্কস, মাও সে তুং, হো চি মিন, ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা_বিশ্বের মহান কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ছবি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাহিত্যিক জহির রায়হান যুদ্ধ চলাকালে বিদেশে প্রচারের জন্য 'স্টপ জেনোসাইড' (ঝঃড়ঢ় মবহড়পরফব) নামে যে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন, তার শুরুতেই ছিল লেনিনের ছবি ও তাঁর একটি বাণী। তার মানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বিশ্বব্যাপী মানবমুক্তির সংগ্রামেরই গর্বিত অংশ। নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুও তাই-ই মনে করেন। পরিচালক যে জীবনদর্শনে বিশ্বাস করেন, তার প্রতিফলন তো পড়বেই তাঁর সৃষ্টিতে। এসব বিপ্লবীর ছবির প্রতীকী অর্থ আছে। তবে পরিচালক নাসিরউদ্দীন ইউসুফ নান্দনিক সৌন্দর্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে স্থূলভাবে কোনো মতাদর্শ প্রচার করেননি। কমিউনিস্ট বিপ্লবী ছাড়াও মহাত্মা গান্ধী, মাদার তেরেসা, জোয়ান অব আর্কের ছবিও এসেছে। জোয়ান অব আর্ক মধ্যযুগের সেই নারী ব্যক্তিত্ব, যিনি স্বদেশের (ফ্রান্সের) স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। চলচ্চিত্রের বিলকিসও স্বাধীনতার যোদ্ধা, নারী যোদ্ধা। তাই জোয়ান অব আর্কের ছবি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। মহাত্মা গান্ধী অবশ্য যুদ্ধ, সহিংসতায় বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু তিনি তো ভারতবর্ষের স্বাধীনতাসংগ্রামের মহান নেতা। তাই তাঁর ছবিও প্রাসঙ্গিক। মাদার তেরেসা যুদ্ধ বা রাজনীতি করেননি। কিন্তু তিনি সারা জীবন মানবমঙ্গলের জন্য কাজ করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্য তো মানবমঙ্গল। তাই কোনো ছবিই অপ্রাসঙ্গিক নয়। এক ঝলকে হলেও এসব মহানয়াকের ছবি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক তাৎপর্য এবং গভীরতর লক্ষ্য ও ভাবাদর্শ তুলে ধরেছে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্যই এই যুদ্ধ ছিল না। শ্রেণী শোষণ থেকে সব ধরনের শোষণ, অত্যাচার ও অসাম্য থেকে মুক্তিলাভই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলকথা। মুক্তিযুদ্ধের ছবি অঙ্কন করতে গিয়ে পরিচালক সংগতভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষা ও চেতনাকে তুলে ধরেছেন। তবে মূলভাবে নয়, শিল্পের মাধ্যমে। সেই চেতনা হলো সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা, যেটা পরিচালক নিজেও ধারণ করেন।
কোনো মহৎ শিল্পকর্ম বা সাহিত্য উদ্দেশ্যহীন হতে পারে না। এটা মার্কসবাদের কথা। মিনা কাউটস্কিকে লেখা এক চিঠিতে (২৬ নভেম্বর, ১৮৮৫) এঙ্গেলস গ্রিক ট্র্যাজেডির জনক এসকাইলাস, কমেডির জনক অ্যারিস্টোফেনিস, কবি দান্তে, সার্ভেন্টিস, শিলার এবং তৎকালীন রুশ ও নরওয়ের লেখকদের সম্পর্কে বলছেন, 'তাঁরা সবাই উদ্দেশ্যপ্রবণতা নিয়ে লিখেছেন।' একই কথা বালজাক সম্পর্কে মার্কস এবং তলস্তয় সম্পর্কে লেনিন বলেছেন। যুগের চাহিদা বা সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তা উৎকৃষ্ট সাহিত্য বা শিল্পকর্ম হতে পারে না। আমাদের হাতের কাছেও একটা বড় উদাহরণ আছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের অসাধারণ উপন্যাস 'নূরজাহান' বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত লিখিত, যা একই সঙ্গে সামাজিক প্রয়োজন ও তাগিদ মেটাচ্ছে, লেখকের কমিটমেন্ট তুলে ধরছে, পাঠকের চেতনাকে বৃদ্ধি করছে। আবার স্থূল প্রচারধর্মী না হয়ে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে নান্দনিক উৎকর্ষ ও অতি উঁচুমানের সাহিত্য মূল্য। মাও সে তুং তাঁর বিখ্যাত ইয়েনেনের বক্তৃতায় (বিপ্লব চলাকালে শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে অসামান্য রচনা) অৎঃ ভড়ৎ ধৎঃ'ং ংধশব-এর তত্ত্বকে খণ্ডন করেও বলেছেন যে_'সাহিত্য বা শিল্পকে পোস্টার বা স্লোগানের স্তরে নামিয়ে আনলে চলবে না।' আমি শিল্প সমালোচক নই। তাই চলচ্চিত্রটির খুঁটিনাটি টেকনিক্যাল বিষয়ে যাব না। সে যোগ্যতাও আমার নেই। তবে এটুকু নিশ্চয়ই জোরের সঙ্গেই বলতে পারি, চলচ্চিত্রটি আর্ট হিসেবেও খুব উঁচু স্তরের। ছবিটির পরতে পরতে যেসব চিত্রকল্প ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে উঁচুমানের শিল্পী-মনের পরিচয় পাওয়া যায়, যা সমগ্র ছবিটিকে এক চমৎকার কাব্যময়তা দান করেছে। চলচ্চিত্রে এমন কাব্যময়তা, তাও আবার যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আর নেই। থাকলেও নিশ্চতভাবেই খুব বেশি নেই, অন্তত আমার জানা নেই। এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও বীভৎসতার ছবি আছে (পানিতে ভাসমান লাশ দেখে বিলকিসের বমি আসছে_এ দৃশ্যটি শিল্পী জয়া আহসান যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তার প্রশংসা না করে পারা যায় না), মানুষ জবাই করার দৃশ্যও আছে। তবু সামগ্রিকতায় ছবিটি একটি চমৎকার কবিতার মতো মনে হয়েছে। চলচ্চিত্রে মহাকাব্য বলে যে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে, তাও মিথ্যা নয়। ঘটনার উপস্থাপনা, পারিপাশ্বর্িক চিত্র, প্রবল বৃষ্টিপাত, বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে রক্তের স্রোত, ট্রেনযাত্রা, ট্রেনে বিলকিসের অকস্মাৎ বোরকা খুলে ফেলা, যুদ্ধের প্রস্তুতি, রাতের অন্ধকার, মুক্তিযোদ্ধাদের একসঙ্গে বসে খাওয়া, প্রচণ্ড অত্যাচারের মুখেও মনোবল দৃঢ় রাখা, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও 'জয় বাংলা' ধ্বনি উচ্চারণ, ইত্যাদি দৃশ্য খুবই চমৎকার, গূঢ় অর্থবহ এবং পরিচালকের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা, শিল্পবোধ, অরিজিনালিটি ও প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।
অভিনয় সবারই নিখুঁত হয়েছে বলে আমার মনে হয়। বিলকিসের চরিত্রে জয়া আহসানের অভিনয় আমাদের রীতিমতো মুগ্ধ করে। প্রতিটি দৃশ্যেই তাঁর অভিনয় অনবদ্য। শেষ দৃশ্যে বন্দি বিলকিস যখন গ্রেনেডের পিনটি খুলে পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে মারবে এবং নিজেও মরে আত্মসম্মান রক্ষা করবে, তখন তার যে অভিব্যক্তি (এঙ্প্রেশন), তা চলচ্চিত্র শিল্পে ও অভিনয় জগতে অমর হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার খুব ভালো লেগেছে এই ভেবে যে নতুন প্রজন্মের মধ্যে আমরা এক প্রতিভাবান শিল্পীকে পেয়েছি। পরিচালক ও নির্মাতা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু গেরিলা চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করে বড় রকমের জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। ছবিটির রাজনৈতিক তাৎপর্য বিরাট। ছবিটি নির্মাণ করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বড় ধরনের অবদান রেখেছেন। আর এঙ্গেলসের ভাষায় বলতে হয়_'সংস্কৃতির পথে যে কোনো একটি পদক্ষেপ মুক্তির পথেই একটি পদক্ষেপ।'
পুনশ্চ : লেখাটি শেষ করার পর জানা গেল ১৭তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে গেরিলা ছবিটি এশিয়ার সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে জিতে নিয়েছে ন্যাটপ্যাক সম্মাননা। ১৭ নভেম্বর ২০১১ সন্ধ্যায় উৎসবের শেষ দিন এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে গেরিলা সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে সম্মাননা লাভ করে। এ সংবাদটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও গর্বের।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.