ডিসিসির সর্বাঙ্গে দুর্নীতির ক্ষত by হকিকত জাহান হকি

ঢাকা সিটি করপোরেশনে (ডিসিসি) প্রায় সবক্ষেত্রে দুর্নীতির আলামত চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কার পার্কিংয়ের ভবন নির্মাণ, বিভিন্ন মার্কেটের দোকান বরাদ্দ, বিলবোর্ড স্থাপন, টেন্ডার প্রক্রিয়া, সংস্কার কাজ, বাস টার্মিনাল নির্মাণ, টোল আদায় ও জ্বালানি তেল কেনায় চলছে লাগামহীন দুর্নীতি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি বিশেষ টিম প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি চিহ্নিত করতে গিয়ে ওইসব ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করেছে। অনুসন্ধানকালে পাওয়া দুর্নীতির তথ্য অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।


দুদক সূত্রে জানা গেছে, ওইসব ক্ষেত্রে কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। মেয়র, সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), প্রধান প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তাদের ওইসব অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য প্রাথমিকভাবে পেয়েছে দুদক।
সূত্র জানায়, এক বছর ধরে ডিসিসির প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি চিহ্নিত করার কাজ চলছে। প্রথম পর্যায়ে উপ-পরিচালক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম কাজ শুরু করে। বর্তমানে সহকারী পরিচালক হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে একটি টিম কাজ করছে।
দুদক পরিচালক নূর আহাম্মদ সমকালকে বলেন, ডিসিসির প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি চিহ্নিত করা, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও দুর্নীতির ফাঁক-ফোকর বন্ধ করতে এ টিমকে আরও শক্তিশালী করা হবে। এ লক্ষ্যে শিগগির কমিশনে প্রস্তাব পেশ করা হবে। তিনি বলেন, সম্প্রতি অনুসন্ধানকালে নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করা হয়েছে। ওইসব ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। সরকারের সেবামূলক এ প্রতিষ্ঠানের কাজে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনে দীর্ঘ সময় নিয়ে অনুসন্ধান করা হবে বলে জানান তিনি। জানা গেছে, রাজধানীর গুলশান-১
ও ২, বনানী-১, মতিঝিল, দিলকুশা, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ডিসিসির কার পার্কিং-কাম-বাণিজ্যিক ভবন নির্র্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, কার পার্কিং ভবন নির্মাণে টেন্ডার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্মাণকাজ পর্যন্ত সবক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। বিভিন্ন মার্কেটে দোকান বরাদ্দের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময় গৃহীত সংস্কার ও উন্নয়ন কাজে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। এ ছাড়া বাস টার্মিনাল নির্মাণ, টোল আদায় ও জ্বালানি তেল ক্রয়ে জাল-জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।
দুদক টিম অনুসন্ধানকালে সর্বক্ষেত্রে নথিপত্র সংগ্রহ করেছে। নথিপত্রে মেয়র সাদেক হোসেন খোকাসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওইসব ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের আটটি মার্কেটে নিয়ম ভঙ্গ করে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মর্মে একটি অনুসন্ধান করছেন দুদকের সহকারী পরিচালক লুৎফর রহমান। এসব মার্কেটের দোকান কীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং দোকান কেনার নথি কীভাবে চলাচল করেছে_ এসব তথ্য চেয়ে ডিসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা গোলাম রহমান মিয়ার কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। মার্কেটগুলোর মধ্যে রয়েছে_ রাজধানীর বাংলাবাজারের ট্রেড সেন্টার, গুলিস্তানের পুরনো হকার্স মার্কেট, টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেট, পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিল, মিরপুরের শাহআলী মার্কেট, কারওয়ান বাজার ডিসিসি মার্কেট, মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজার ও এছাহাক মার্কেট।
দুদক সূত্র জানায়, রাজধানীর দিলকুশায় ডিসিসির জমিতে কার পার্কিং-কাম-বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে বড় ধরনের জালিয়াতি ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। বিসিআইসি ভবনের সামনে দুই বিঘা জমিতে ২৪ তলাবিশিষ্ট এ ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ভবনের দুটি বেজমেন্ট ফ্লোরসহ মোট চারটি ফ্লোর নির্মাণের ব্যয় নির্ধারণ করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এমআর ট্রেডিং করপোরেশনকে ১১ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৭৭৭ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি উপরিভাগের দুটি ফ্লোর নির্মাণ না করে শুধু বেজমেন্টের দুটি ফ্লোর নির্মাণ করে ডিসিসির সঙ্গে যোগসাজশে বরাদ্দকৃত পুরো টাকা তুলে নেয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে উপরিভাগের তিনটি ফ্লোর নির্মাণের জন্য ১১ কোটি ৬২ লাখ ১৬ হাজার টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ সময় বেজমেন্টের উপরিভাগে তিনটি ফ্লোর নির্মাণ করা হয়।
বিলবোর্ড স্থাপন ও বিজ্ঞাপন কর আদায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির খবর পাওয়া গেছে। ঢালাও দুর্নীতির কারণে এ খাতে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিজ্ঞাপন স্থাপনকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অবৈধভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিজ্ঞাপন বোর্ড স্থাপনের সুযোগ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। অনেকেই ১০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১০ ফুট প্রস্থের বিজ্ঞাপন বোর্ডকে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থ করেছেন। এ জন্য তাদের ডিসিসিকে অতিরিক্ত কর দিতে হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.