কয়লার ময়লা by শেখ রোকন

গুনঝরা আন্দোলনের পরও দেশের বৃহত্তম মজুদ ফুলবাড়ী থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হবে কি-না_ এ নিয়ে বাংলাদেশ দোলাচলে থাকলেও বাকি বিশ্বে 'নোংরাতম জ্বালানি'টির ব্যবহার বেড়েই চলেছে। কেবল উত্তোলন পদ্ধতি নয়, পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণেও কয়লা ব্যবহারের বিপক্ষে জনমত প্রবল। বিশেষ করে পরিবর্তিত জলবায়ুর এই সময়ে। কারণ জ্বালানির মধ্যে কয়লাই সবচেয়ে বেশি কার্বন উদ্গিরণ করে থাকে।


তা সত্ত্বেও কয়লার ব্যবহার বাড়ছে। গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বৈশ্বিক এজেন্ডা হওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল কয়লার ব্যবহার কমবে। দেখা যাচ্ছে উল্টো ফল। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ২০০৬ সালে যখন নাইরোবিতে আলোচনা শুরু হয়, তখন বিশ্বের প্রাথমিক জ্বালানির ২৫ ভাগ আসত কয়লা থেকে। এখন সেটা প্রায় ৩০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কার্বন নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আলোচনা যখন তুঙ্গে, সেই ২০০৯-১০ সালেও কয়লার ব্যবহার বেড়েছে ৮ শতাংশ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেসব দেশ থেকে কার্বন উদ্গিরণ কমানো বেশি জরুরি, কয়লা ব্যবহারে এগিয়ে তারাই। আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনের আসন্ন মেজবান দক্ষিণ আফ্রিকার বিদ্যুতের ৯৩ শতাংশ উৎপাদিত হয় কয়লার আশীর্বাদে। তারপর রয়েছে চীনের ৮০, ভারতের ৭০ ও যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ শতাংশ। দক্ষিণ আফ্রিকার আরও কয়লা-কীর্তি রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার উপযোগী কয়লা রফতানিতেও এক নম্বরে তারা। এ বছর ডিসেম্বরে ডারবানে জলবায়ু পরিবর্তনের বৃহত্তম বার্ষিক আয়োজনের ভেন্যুর মাত্র দুই ঘণ্টা গাড়ি রাস্তার দূরত্বে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম কয়লা রফতানি বন্দর রিচার্ডস বে। সেখান থেকে হরদম কয়লা বোঝাই জাহাজ ইউরোপ ও এশিয়ার উদ্দেশে পাল তোলে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বড় ভরসা হতে পারত নবায়নযোগ্য জ্বালানি। প্রত্যাশা ছিল, বিভিন্ন দেশ ধীরে ধীরে কয়লা ও তেলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সেদিকে ঝুঁকবে। কিন্তু বাস্তবে সবচেয়ে খারাপ জ্বালানিটির ব্যবহারই বাড়ছে আর বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমেই বেশি কার্বন-প্রসবা হয়ে পড়ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে চীনের সাফল্যের কথা বিশ্বব্যাপী উচ্চারিত হয়। সেটা মিথ্যা নয়, তবে ফাঁক রয়েছে। দেশটিতে সৌর বা বায়ু বিদ্যুতের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ গতিতে বাড়ছে কয়লার ব্যবহার। ভারতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে মহাযজ্ঞ চলছে; কিন্তু কয়লাযজ্ঞ তার চেয়েও মহান। ভারতের নিজের বিশাল মজুদ সত্ত্বেও দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে জাহাজকে জাহাজ কয়লা মুম্বাইতে ভিড়ছে। অন্যদিকে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার পর, নবায়নযোগ্য এই জ্বালানির দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল পথে যেসব দেশ হাঁটছিল, তারা থমকে দাঁড়িয়েছে। উল্টোও ঘুরেছে। জার্মানি ইতিমধ্যেই সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের পরিকল্পনা করছে। তার মানে, কৃষ্ণ জ্বালানির আরও জয়জয়কার।
জ্বালানি হিসেবে কয়লার জনপ্রিয়তার মূল কারণ সস্তা দাম। প্রকৃতিতে মেলেও প্রচুর। পরিবহনও সহজ, অন্যান্য পেট্রোলিয়াম দ্রব্যের মতো 'বিপজ্জনক' লিখে রাখতে হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, সস্তার জ্বালানি আর কতদিন আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের তিন অবস্থা করতে থাকবে?
এর একটি উত্তর হতে পারে 'ক্লিন কোল' বা পরিবেশসম্মত কয়লা। যাতে করে প্রবৃদ্ধি ও জলবায়ু, দুটিই বাঁচে। কয়েক বছরের প্রচেষ্টার পর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া ধরে রেখে সেটাকে তরল করে মাটিতে পুঁতে ফেলার প্রযুক্তি পেলেই তা সম্ভব। কিন্তু সেটা এখনও দূরের বাদ্য। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কয়েক দশক পরে তা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু সস্তা জ্বালানিতে অভ্যস্ত ও মন্দায় জেরবার বিশ্ব এই সময় ও খরচ দিতে রাজি কি-না তাও ব্যাপার বটে।
এখন আমরা কি নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার পর্যন্ত কয়লা তোলা বন্ধ রাখব, নাকি তুলে ফেলে জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার বদনাম ঘুচাব?
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.