গ্রেফতার এড়াতে বারবার স্থান পাল্টাচ্ছেন বাচ্চু by পিনাকি দাসগুপ্ত ও প্রীতিরঞ্জন সাহা

রসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার প্রধান আসামি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ছোট ভাই পলাতক সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু গ্রেফতার এড়াতে বারবার স্থান পরিবর্তন করছেন। ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিরামহীন অভিযান চালিয়েও তাকে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। এদিকে রিমান্ডে থাকা যুবলীগ নেতা আশরাফ জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, লোকমান হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে


সবকিছুর সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। তবে তিনি নিজে লোকমানকে গুলি করেননি। নরসিংদী ডিবি তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। গতকাল শুক্রবার ছিল জিজ্ঞাসাবাদের তৃতীয় দিন।
অন্যদিকে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুর মতিন সরকার গ্রেফতারের বিষয়টি গতকাল পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে কেউ স্বীকার করেননি। ঢাকা রেঞ্জের
ডিআইজি আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, আবদুল মতিন সরকার গ্রেফতার হয়েছেন_ এ ধরনের কোনো তথ্য নরসিংদী ও নোয়াখালী পুলিশের কাছে নেই।
নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন সমকালকে বলেন, মেয়র লোকমান হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত তিনজন গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। মামলা তদন্তেও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। তিনি বলেন, শিগগির প্রকৃত আসামিদের চিহ্নিত করে আইনের হাতে সোর্পদ করা সম্ভব হবে।
গত সোমবার উচ্চ আদালতে আগাম জামিন নিতে গিয়ে বাচ্চু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এরপর থেকে তিনি গ্রেফতার এড়াতে বারবার স্থান পরিবর্তন করছেন। পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে, বাচ্চু রাজধানীর বাড্ডা, উত্তরা ও পুরান ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট এলাকা এবং নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় আত্মগোপনে ছিলেন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে তাকে গ্রেফতারে মেঘনাঘাট এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। তবে অভিযানের কয়েক ঘণ্টা আগেই তিনি ওই বাড়ি ত্যাগ করেন। এরপর পুলিশ ওই রাতেই নরসিংদীর মাধবদী এলাকায়ও অভিযান চালায়। সেখানেও পুলিশ তাকে গ্রেফতারে ব্যর্থ হয়। তবে রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নরসিংদী পুলিশ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের চারটি টিম অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
সূত্র জানায়, মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুসহ অন্য আসামিদের গ্রেফতারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা ও নরসিংদী পুলিশ একসঙ্গে কাজ করছে। গতকাল রাতে সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু ও মন্ত্রীর এপিএস মুরাদকে গ্রেফতারের জন্য নরসিংদী এবং নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে অভিযান চালানো হয়েছে; কিন্তু তাদের কোনো সন্ধান পায়নি।
রিমান্ডে আশরাফ যা বলেন : আমি গুলি করিনি, মামলার এজাহারে যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা মিথ্যা। তবে হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছি। লোকমানকে গুলি করার সময় আমি আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গদিঘরে ছিলাম। গুলি হওয়ার পর শহরের অবস্থা জানার চেষ্টা করি। তবে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া বা ঘটনাস্থলের আশপাশে যারা ছিল তাদের দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলাম। হত্যাকাণ্ডের পর ওইদিন রাতেই মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন বাচ্চুর নির্দেশে নরসিংদী ত্যাগ করি।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, লোকমান হত্যার তদন্ত অনেকদূর এগিয়েছে। শিগগির হত্যার রহস্য উন্মোচন করার আশা পোষণ করেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
অভিযানে অংশ নেওয়া এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুসহ বেশ ক'জন আসামি ঘটনার পর ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। উচ্চ আদালত জামিন আবেদন ফিরিয়ে দেওয়ার পর থেকেই তারা ঢাকা ছেড়ে অন্যত্র আত্মগোপন করেন। তবে পুলিশ আত্মগোপনের বেশ ক'টি স্থান শনাক্ত করতে পারলেও বারবার স্থান পরিবর্তন করছেন তারা। ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা হাল ছড়িনি। আশা করি আমরাই গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করতে পারব।
মামলার তদন্ত সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত টিপ্পন, ঢাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া যুবকের (পুলিশ তার নাম প্রকাশ করেনি) দেওয়া তথ্যের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। ওই যুবক রাজধানীর পুরান ঢাকার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। যুবকটির সঙ্গে যুবলীগ নেতা আশরাফের ভগি্নপতি গুলিস্তানের কাপ্তান বাজারের একটি মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের সম্পর্ক রয়েছে। দুলাভাইয়ের মাধ্যমেই ওই যুবকের সঙ্গে আশরাফের পরিচয়। এ ছাড়া আশরাফের শ্বশুরবাড়ি পুরান ঢাকার কলতাবাজারে।
নরসিংদী পুলিশের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, কী কারণে লোকমানকে হত্যা করা হয়েছে তা পরিষ্কার হয়েছে। তবে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী কিলারদের ধরতেই কৌশলগত কারণে যুবকের গ্রেফতার ও পরিচয় গোপন করা হয়েছে। তাকে এখনও গ্রেফতার দেখানো হয়নি।
নরসিংদী ডিবি পুলিশের হেফাজতে রয়েছে আশরাফ হোসেন সরকার, টিপ্পন ও হাজি সেলিম। এর মধ্যে হাজি সেলিম দ্বিতীয় দফায় চারদিনের রিমান্ডে রয়েছেন। গতকাল ছিল তার রিমান্ডের প্রথম দিন। অন্যদিকে টিপ্পন রয়েছেন আটদিনের রিমান্ডে। গতকাল তার ছিল চতুর্থ দিন।
আওয়ামী লীগ নেতা মতিন সরকারের ভাইয়ের দাবি তিনি গ্রেফতার হননি : আবদুল মতিন সরকারের ছোট ভাই ইট ব্যবসায়ী শরিফ হোসেন সরকারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সমকালকে বলেন, আমার ভাই মতিন সরকার গ্রেফতারের বিষয়টি পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। পাশাপাশি অনেকে আমার কাছে টেলিফোনে গ্রেফতারের বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছেন। তিনি আরও বলেন, আমার ভাই মতিন সরকার কোথায় আছেন, গ্রেফতার হয়েছে কি-না সে ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে মতিন সরকারের অন্য ছোট ভাই স্থানীয় মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল শওকত হোসেন গ্রেফতারের বিষয়টি ভুয়া বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, গ্রেফতার হলে আমরা খবর পেতাম। তবে মতিন সরকার কোথায় আছেন তা তিনি জানেন না।
এদিকে মেয়র লোকমান হত্যার প্রতিবাদে গতকাল শালিধা স্কুলমাঠে প্রতিবাদ সভা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন নরসিংদী সদর থেকে নির্বাচিত এমপি লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক। শালিধা, চৌয়ালা, শাহেপ্রতাপ, সাটিরপাড়া, বাগদী ও বাশাইল এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করেন নরসিংদী পৌরসভার কাউন্সিলর মুক্তিযোদ্ধা মোবারক হোসেন। সভায় ইউএমসি জুট মিল সিবিএর সভাপতি মোঃ হারিসুল হক শিশু মোল্লা, লোকমান হত্যা মামলার বাদী কামরুজ্জামান কামরুল, তার ছোট ভাই নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি শামীম নেওয়াজ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আঃ মতিন ভূঞা, ড. মশিউর রহমান মৃধা, ঠিকাদার ফারুক সরকার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
শোকসভার বক্তব্যে এমপি হিরু বলেন, জননেতা মেয়র লোকমান হত্যাকারীরা ধরা পড়ছে। কেউ ছাড়া পাবে না। শিগগির অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

No comments

Powered by Blogger.