একজন আদৃতা ও হৈমন্তীর গল্প-সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ by শম্পা ইফতেখার

প্রাণহীন দেহগুলোকে খুব চেনা আর একই রকম মনে হয়। তাদের কষ্টের অভিব্যক্তি মৃত্যুর শীতল আলিঙ্গনেও সুস্পষ্ট। রিমা থেকে রোমানা, বিলাসী, হেনা থেকে টাঙ্গাইলের আম্বিয়া বা মডেল আদৃতা সবাইকে একই যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে দেখি। নারীবৈষম্য বা নির্যাতন বিত্ত-বংশ পরিচয় বুঝে হয় না বলেই তাদের মুখচ্ছবিতে এত সাদৃশ্য। বেদনার আর্তি সর্বজনীন বোধ করি। জাত-কাল-পাত্রভেদে এর রূপ-রঙ বদলায় না।
তাই আগুনে আত্মাহুতি দেওয়া বিলাসীর যে বেদনা সে বেদনার একই রঙ বিচ্ছুরিত হয়েছিল রিমার ক্ষতবিক্ষত দেহ থেকে। এই একই কষ্ট আজীবন বয়ে যাবে দৃষ্টিহীন রোমানা। নারায়ণগঞ্জে সেলিনা হায়াৎ আইভী যেদিন জয়লাভ করেন, ঠিক সে রাতেই তাজমহল রোডের এক বাসার ছাদঘরে লাশ মেলে মডেল আদৃতার। পচে ফুলে যাওয়া বীভৎস সে লাশ আমাদের নিরাপত্তাহীনতার স্বাক্ষর। ভালো মেয়ে হোক বা মন্দ; উচ্চাভিলাষী অথবা ঘরমুখী_ সর্বত্র আমরা বড্ড বেশি নিরাপত্তাহীন। তাই সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিজয়ী হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিশ্চিত করেনি আমাদের সাধারণ মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা। আতঙ্কিত থাকি প্রতি মুহূর্তে।
ক্ষমতাশীল নারীর তালিকা চিন্তা করলেই চোখে ভেসে আসে হিলারি ক্লিনটন, কন্ডোলিৎসা রাইস, ইন্দিরা গান্ধী, বর্তমান সময়ের ইংলাক সিনাওয়াত্রা, সোনিয়া গান্ধী, মমতাসহ হাজারো মুখ। আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই। আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। দু'জনই নারী ক্ষমতায়নের চূড়ান্ত উদাহরণ। উল্লেখ্য, এর পরও স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি আমাদের। বদলে যায়নি আমাদের চারপাশের শঙ্কিত পরিবেশ। প্রতিনিয়তই কোনো না কোনোভাবে অত্যাচারিত নারীর মিছিলে যুক্ত হচ্ছে একটা ধর্ষিত লাশ, এসিডে ঝলসে যাওয়া মুখ, পারিবারিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ-অসহায় একটা হৃদয় কিংবা ইভ টিজিংয়ে বিক্ষিপ্ত এক মন। রবিঠাকুরের হৈমন্তীকে অগোচরে ধারণ করি আমরা। কী বিষণ্ন সেই চোখ_ নিয়মবাণে জর্জরিত মৃত্যুমুখী হৈমন্তী।
পত্রিকায় যেটুকু নারী নির্যাতনের চিত্র আমরা পাই, বাস্তবে তার চিত্র ও সংখ্যা আরও ভয়াবহ ও বেশি_ এ কথা কোনো পরিসংখ্যানের বরাত না দিয়েও অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বলা যায়। আধুনিক প্রযুক্তি নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। মোবাইল ফোনে উত্ত্যক্ত করা বা অশ্লীল ভিডিও বার্তা ও চিত্র প্রেরণ এখন আর নতুন কিছু নয়। কিন্তু যার ছবি নোংরাভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে বা যাকে অশ্লীল বার্তা ও ছবি পাঠানো হচ্ছে তার মানসিক কষ্ট আমাদের সভ্য মনকে নাড়া দেয় না, বরং আমরা উপসংহার টানি নির্যাতিতের চরিত্র হনন করে_ খারাপ মেয়ের এ শাস্তিই প্রাপ্য। একবারও ভাবি না_ অসীম, অগাধ বিশ্বাস না থাকলে কেউ কোনো ধরনের শারীরিক সম্পর্কে যায় না। সেই সরল বিশ্বাসের অন্তরালে দানবের লালসার জালে আটকে যায় সহজ-সরল কোনো এক কিশোরী বা তরুণী। আমরা ভুলে যাই বিশ্বাসহীন পশুটা কতটা অমানবিক আর কত বড় একটা অন্যায় করে পার পেয়ে যায়। উল্টো শাস্তি পায় আমাদেরই বোন, নিকটাত্মীয় অথবা অচেনা এক হৈমন্তী। দরকার সচেতনতার। অস্বীকার করার জো নেই, আজ আমরা অনেক বেশি আধুনিক। ছেলে বন্ধু থাকাই খুব স্বাভাবিক একজন কলেজ বা ইউনিভার্সিটি পড়া তরুণীর। কিন্তু মনের উঠানজুড়ে সোনালি সূর্যের রঙছটায় যে কাউকে নিয়ে জীবন রাঙানোর চিন্তা করার আগে সময়ের ওপর অনেক বিচার ছেড়ে দেওয়া সমীচীন। আজ যে বন্ধু আমার না চাইতেই আকাশজোড়া মেঘ এনে দেয়, তারাভরা রাতে হাজারো স্বপ্নের গল্প শোনায়_ সেই বন্ধুই অমাবস্যার অন্ধকারে জীবনটা পথহীন বেহাল করে দিতে পারে এক নিমিষেই। তাই অতি আবেগী চিন্তা নয়, কিছুটা বুদ্ধিভিত্তিক বিচার-বিশ্লেষণও বন্ধু নির্বাচনে জরুরি।
তথ্যপ্রযুক্তির সদ্ব্যবহার অবশ্যই জরুরি। মোবাইল ফোন হোক বা কম্পিউটার_ দুইয়ের ব্যবহারের ক্ষেত্রে শালীনতা ও পরিমিতিবোধ খুব প্রয়োজন। আধুনিক অভিভাবক রক্ষণশীল বা গোঁড়া হবেন_ এটা কাম্য নয়; কিন্তু সন্তানের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ দ্বারা অনেক নির্দেশনা তারা দিতে পারেন। এর ফলও অনেক কার্যকর হয়। এর জন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন। এ বন্ধনই নিশ্চিত করে সন্তানের সুস্থ মানসিক বিকাশ। তাই সচেতন বাবা-মায়ের উচিত, মাত্রাতিরিক্ত শাসন বা আদর নয়; বরং যথাযথ বন্ধুবৎসল আচরণের মাধ্যমে সন্তানের নৈতিকতাবোধ তৈরি করা, যাতে অবাধ স্বাধীনতা পেলেও বখে না যায়। সেই মা অথবা বাবাই সেরা বন্ধু, যার সঙ্গে সন্তান অবলীলায়, পরম নির্ভরতায় নিজের দুঃখ-কষ্ট, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চিন্তা-ভাবনা ভাগ করে নেয়। সে ক্ষেত্রে বেঁচে যাবে কিছু প্রিয় মুখ_ সে মুখ হয়তো আদৃতার অথবা হৈমন্তীর।

শম্পা ইফতেখার :শিক্ষক, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি
ishampa@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.