মা ও শিশুর পুষ্টি ভালো নেই by মানসুরা হোসাইন

০ বছর বয়সী লিকলিকে শরীরের বিলকিস তিন সন্তানের মা। বড়টার পাঁচ বছর, আর সবচেয়ে ছোটটার বয়স চার মাস। গত শনিবার সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজার পাতাল-পারাপারে কথা হয় বিলকিসের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের খাওয়া শেষে শুধু মাছ বা মাংসের ঝোলসহ যা অবশিষ্ট থাকে, ১০ টাকা করে দুই প্লেট খাবার কিনে স্বামী ও তিন বছর বয়সী ছেলেকে নিয়া খাইছি। সারা দিনে এ খাবার একবারই জুটছে। জিনিসের যে দাম, কী আর খামু! দিনে একবার খাই, তা-ও পেট ভরে না।

স্বামীর আমড়া বিক্রি ভালো হইলে দিনে আরেক বেলা খাবার জোটে। চার মাস বয়সীটা বুকের দুধ খাইয়া থাহে। বড়টারে তার নানির কাছে দিয়া দিছি। অন্যটারে এক বেলা ভাত, আর অন্য সময় চকলেট, রুটি কিন্যা দিয়া চুপ করাইয়া রাখি।’ তবে বিলকিস বলেন, ‘তয় ছোটবেলায় এক বাসায় কাম করতাম, তহন শিখছিলাম, পোলাপানরে মিষ্টি কুমড়া, চাল, ডাল, তেল ও অন্যান্য সবজি দিয়া খিচুড়ি বানাইয়া খাওয়াইতে অয়।’
ঢাকা শিশু্রহাসপাতালের অধ্যাপক নায়লা জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন কৌটা ও প্যাকেটজাত খাবারের বিজ্ঞাপনের দৌরাত্ম্যে গ্রামের একটি শিশুর হাতেও থাকছে চিপসের প্যাকেট। অথচ চিপসের দাম দিয়েই কলা কেনা সম্ভব। আমরা অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা চালাচ্ছি।’
অন্যদিকে কারওয়ান বাজারের তরকারি বিক্রেতা রুনা তাঁর আট মাস বয়সী মেয়েকে শুধু বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন। রুনা বলেন, ‘বুকে দুধ আছে, অন্য খাবার কেন দিমু। দুধ না পাইলে অন্য কথা আছিল।’ এই মায়ের কাছে পৌঁছায়নি বুকের দুধ খাওয়ানোর নিয়মাবলি।
দেশের পুষ্টি ও শিশু বিশেষজ্ঞরা মা ও শিশুর পুষ্টির পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ মহসীন আলী বলেন, ২০০৭ সালের সর্বশেষ বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের তথ্য অনুযায়ী ১৭ শতাংশ শিশুই মারাত্মক অপুষ্টির শিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, কোনো দেশে মারাত্মক অপুষ্টির হার ১৫ শতাংশের বেশি হলে জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয়।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সেন্টার ফর নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটির পরিচালক তাহমীদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অপুষ্টির কারণে শিশুর রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যায়। সংক্রামক রোগ বেশি হয়। এই শিশুদের মারা যাওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে। বাঁচলে বুদ্ধির মাত্রা কম হওয়ার কারণে প্রাপ্তবয়স্ক হলেও কর্মক্ষমতা কম থাকে, যার প্রভাব পড়ে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে।
বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এস কে রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের নারীদের গড় উচ্চতা ১৫০ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার, যাকে খাটোই বলা চলে। ৪০ শতাংশ নারীর ওজন কম। অর্থাৎ , অপুষ্ট মায়ের গর্ভ থেকে বাচ্চা জন্মাচ্ছে কম ওজন নিয়ে। তাই পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে মা ও শিশুকে আলাদাভাবে বিবেচনা করলে হবে না। মায়ের পুষ্টির দিকে সমান নজর দিতে হবে।’
পুষ্টিবিদেরা বলেন, অপুষ্ট মা মেয়েসন্তান প্রসব করলে সেই অপুষ্ট সন্তানটির বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তারপর সেই অপুষ্ট মা আবার অপুষ্ট সন্তান জন্ম দিচ্ছে। অপুষ্টির এ চক্র পিছু ছাড়ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার সিফায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে সরকার পুষ্টির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মূলধারার কাজে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। “জাতীয় পুষ্টি সেবাসমূহ” কর্মসূচিটি বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে।’
পুষ্ট্রিবিশেষজ্ঞ এস এম মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিচালিত পুষ্টি সেবাসমূহ নামের কর্মসূচির মাধ্যমে প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব।

No comments

Powered by Blogger.