শরতের ফুলেরা by খাদিজা ফাল্গুনি

শান্ত নদী। জলজ চাদরে ঢেউ জাগে কি জাগে না। যেন কিশোরীর হাতের আয়না। জলের আয়নায় উপুড় হয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে নীল-সাদা আকাশ। ধীরে বয়ে যাওয়া নৌকার পালের হাওয়ায় তিরতির করে কেঁপে উঠল নদীর পাড়ে ফুটে থাকা একটি কাশফুল। দৃশ্যকল্পটি শরতের। শুভ্র কাশের স্নিগ্ধ উপস্থিতিই বলে দেয় সে কথা। নয় শুধু ঢাকের শব্দে, নয় ধূপের ধোঁয়াশায়, শরতের আগমনবার্তা প্রথম শোনা যায় শুচিশুভ্র কাশবনে।

কংক্রিটের নগরে এখনো ফোটে কাশ। মুগ্ধ প্রকৃতিপ্রেমীর ফটোফিচারে এখনো দোলে তার শুদ্ধতা। প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মার মনে অবশ্য আমেজ ছড়ায় শরতের আরেক ফুল—শিউলি। কবি নজরুলের প্রিয় শেফালি। জাফরান আর সাদায় মেশানো শিউলি দ্বিজেন শর্মার স্মৃতিতে ডেকে আনে ছেলেবেলা। ‘জোছনা রাতে বাড়ি ভরে যেত শিউলির পাগল করা গন্ধে। পূজার দিন প্রতিমার চোখে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হতো দেবীর। সেই অলৌকিক সময় আজও মিশে যায় শিউলির গন্ধে। পবিত্রক্ষণটি ধরে রাখতেই বুঝি শুচিশুভ্র বসন শিউলির।’
প্রকৃতিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায়ের চোখে এ এক আশ্চর্য কাকতাল। গ্রামের দিকে
শরতের শেষেই হালকা কুয়াশা পড়তে শুরু করে। শিশিরস্নাত শিউলির চাদরের স্মৃতিতে এখনো তাঁর মন ভরে ওঠে।
শুভ্রতা প্রাধান্য পেলেও শরতের ফুলের সাজিতে রং ছোপানো ফুলের কমতি নেই—ঘণ্টা আকৃতির হলুদরঙা এলামেন্ডা, রঙ্গন, সন্ধ্যামণি, বোগেনভেলিয়া, স্থলপদ্ম, বিলাতি জারুল, টগর, মধুমঞ্জরি, কল্কে, শ্বেতকাঞ্চন, রাধাচূড়া, দাঁতরাঙা, ধুতরা, কামিনী, নয়নতারা, ঝাতি, জয়ন্তীসহ আরও কত কী! পূজার থালা রাঙাতেই বুঝি থরে থরে ফোটে ঝুমকো জবা, লটকন জবা, লঙ্কা জবা।
স্বর্ণচাঁপা, কাঁঠালচাঁপার লাজুক হাসিও চোখে পড়ে এই শরতে। শুধু কি স্থল? জলে অজস্র ঢেউয়ের মতো ফুটতে থাকে শাপলা, শালুক, রক্তকমল আর জলপদ্ম।
মৃত্যুঞ্জয় রায় বলেন, তাঁর টবের গাছের ডাল ছেপে ফুটেছে কঙ্কণা, নীলচিতা আর রেইনলিলি।
এই শরতে আপনার সাজও হয়ে উঠুক নান্দনিক। উপাদান একটাই, শারদীয় ফুল। এমনটিই বলেন রূপবিশেষজ্ঞ ফারজানা শাকিল। তিনি বলেন, শরতের ফুল আপনাকে করে তুলতে পারে স্বতন্ত্র। আটপৌরে শাড়ি, কপালে সিঁদুরে টিপ, চোখে কাজল, চুলে কয়েক গাছি শিউলির মালা। বাঙালি নারীর আর কী চাই প্রিয়জনের মন টলাতে! চলছে বিয়ের সময়, কনের গয়না হোক না শিউলির। হলুদসন্ধ্যা হবে সুরভিত।
বেছে নিতে পারেন কাশডাঁটা। ভেঙে চুলের এক পাশে সাজালেন। কাশের শুভ্রতা শুদ্ধতা ছড়াবে সাজে। অথবা নিন মাড়ভাঙা শাড়ি, চুলে এলোখোঁপা। পাশে একটি পদ্ম বা আধফোটা শাপলা।
সাজে আসবে বিশেষ মাত্রা। যদি অবাধ্য চুলগুলো শাসন করতেই হয়, হালকা ফুলিয়ে টার্সেলে বেঁধে ঝুলিয়ে দিন বিনুনির বাঁধনে। বিপরীত পাশে গুঁজে নিন শাপলা বা পদ্ম। পুঁতিতে গেঁথে নিন রঙ্গনের মালা, জড়িয়ে নিন বিনুনিতে অথবা খোঁপায়। জবা পরতে চাইলে খোলা চুলে ব্লো ডাই করে এক পাশে গুঁজে নিন কয়েকটি জবা। চাইলে চুল কোঁকড়া করে জবা পরতে পারেন। আরও বৈচিত্র্য আনতে চাইলে চুল মুড়িয়ে ফেঞ্চেরোল করে এক পাশে আনুন। অন্য পাশে আটকে নিন রক্তজবা অথবা হলুদ এলামেন্ডা।
সকালে পূজা দিতে চলেছেন? গলার কণ্ঠীতে, হাতের বাজুতে জড়িয়ে নিন ধবধবে সাদা টগরের মালা। পূজার স্নিগ্ধ আভা ছড়িয়ে পড়বে আপনার সাজ থেকে। আর যদি ক্লিপ দিয়ে গাঁথেন সোনালি চাঁপা, সৌন্দর্যে-সুগন্ধে আপনাকে করে তুলবে অন্যতমা।
শুধু সাজ নয়, ঘরের সজ্জায়ও নিয়ে আসতে পারেন শরতের নান্দনিকতা। অন্দরসজ্জা বিশেষজ্ঞ রুমানা আফজাল খান বলেন, মাটির চাড়িতে স্বচ্ছ জলে ভাসিয়ে দিন চাঁপা, টগর। অথবা রঙিন পদ্ম ও শাপলা। সঙ্গে থাকুক মোম কিংবা প্রদীপের আলো। শরতের প্রকৃতি টুপ করে ঝরে পড়বে আপনার ঘরে। কাঁসার থালায় নিন উপচে পড়া শিউলি। এক পাশে রাখুন শুভ্র শঙ্খ, উঁচু কাঁসার প্রদীপ জ্বলবে তারই পাশে। দেখুন না, কীভাবে বদলে যায় ঘরের কোণটি।
যদি চান ফুলের আলপনা করতে, তাহলে তো কথাই নেই। হলুদ এলামেন্ডা, রক্তলাল জবা, সবুজ সজীব পাতা আর শ্বেতশুভ্র শিউলি-টগরে নানা জ্যামিতিতে রাঙিয়ে তুলুন মেঝের গম্ভীর মুখ।
যদি চান ঘরের কোণে আলো ছড়াতে, তাহলে কোনায় বসান বড় টব। তাতে রাখুন বড় থালা। থালায় সাজান প্রদীপ, সঙ্গে সবুজ পাতায় মেশানো সাদা শরতের ফুল। প্রদীপের বদলে ব্যবহার করতে পারেন মোমবাতি। আর আয়োজন যদি হয় পূজার, তাহলে থালার ফুলে সাজিয়ে নিন মাটির শরীরে গড়া দেবীর মূর্তি। পাশে থাকবে সিঁদুর, একটি শুভ্র শঙ্খ। ব্যস, সেজে উঠল ঘরোয়া আয়োজন।
শুধু আকাশ নয়, শরতের প্রকৃতিও যে নির্মল সুন্দর, সে তো শারদীয় ফুলেরই অবদান। ফুলে ফুলে সেজেই কি শরৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ? তাই তো!

No comments

Powered by Blogger.