সংকট কাটছে না শেয়ারবাজারে

সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের শেয়ারবাজার। সংকট কাটাতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। বাজারের অবস্থা এখন অনেকটাই তৈলাক্ত বাঁশে বানরের উপরে ওঠার মতো। একদিন শেয়ারদর বাড়লে কমছে পরের তিনদিন। ফলে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া দরপতন কোনোভাবেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। মাঝে গত মে-জুলাইয়ে কিছুটা স্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও তা শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়নি। সর্বশেষ ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে দরপতন হয়েছে ৩৩ দিন।
তবে শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল করতে নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, শেয়ারবাজার কর্তৃপক্ষ, বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোক্তারাও এগিয়ে এসেছেন; কিন্তু তারপরও গত তিনদিন একটানা সূচকের পতন হয়েছে। টানা দরপতনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাদার বিনিয়োগকারীরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ।
এ অবস্থায় সর্বশেষ বাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল নামে মিউচুয়াল ফান্ড গঠনের উদ্যোগেও বাজারে স্বস্তি ফিরে আসেনি। বাজার স্থিতিশীলকরণ ফান্ড গঠন করা সম্ভব হলেও তা পরিস্থিতি মোকাবেলায় কতটুকু সক্ষম হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। গত তিনদিনে সূচক কমেছে প্রায় ১৮৩ পয়েন্ট। পাশাপাশি লেনদেন কমেছে। গতকাল ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে মাত্র ২৮৫ কোটি টাকার শেয়ার।
দরপতনের কারণ : বাজারের সাম্প্রতিক সংকটের কারণ নির্ণয় ও তা প্রতিকারে বাস্তব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি-না, তা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। শেয়ারবাজার
বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা এ বিষয়ে অনেকটা হতাশার সুরে জানান, দরপতনের প্রধান কারণ এবং তা প্রতিকার নির্ণয়ে সংশ্লিষ্টরা অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। তারা জানান, অধিকাংশ শেয়ারের অতিমূল্যায়ন এবং বাজার থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের কারণেই দরপতন হয়। বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, বর্তমান এ অবস্থা থেকে উত্তরণে যদি কিছু করতেই হয়, তবে অবশ্যই দরপতনের এ কারণকে স্বীকার করে নতুন করে ভাবতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ সমকালকে বলেন, গত বছরের ডিসেম্বর নাগাদ প্রায় সব শেয়ারের দর যেখানে পেঁৗছেছিল, সেখানে দরপতন হওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও একমত পোষণ করে বলেন, বাজার অতিমূল্যায়িত হলে দরপতন হবেই; কিন্তু দরপতন সফট ল্যান্ডিং (কিছুটা লম্বা সময়ে ও ধীরে) হলে বিনিয়োগকারীদের পক্ষে সে ধকল কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। কিন্তু এবার সে রকমটি হয়নি। শেয়ারের উত্থান যতটা দীর্ঘ সময়ে হয়েছে, তার তুলনায় খুবই কম সময়ে পতন হয়েছে। আবার টানা দরপতন ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। ফলে প্রত্যেকের বিনিয়োগ তহবিলে টান পড়ছে। অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। সবগুলোর ফলাফল একটাই, তারল্য প্রবাহে ভাটা ও শেয়ার চাহিদা কমা। যার সর্বশেষ পরিণতি দরপতন।
ডিসেম্বর-জানুয়ারির দরপতনের যৌক্তিকতা স্বীকার করলেও সাম্প্রতিক দরপতনের কোনো কারণ আছে বলে মনে করেন না বাজার বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এটা ঠিক, ব্যাংকগুলোর শেয়ার বিক্রি ডিসেম্বরে দরপতনের প্রধান কারণ ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু করার ছিল না। শেয়ারবাজারকে রক্ষার থেকেও দেশের আর্থিক খাত তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষাই প্রধান বিবেচ্য ছিল। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। তিনি বলেন, বর্তমানে অনেকের বিনিয়োগসীমা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশিত সীমার নিচে। আবার মৌলভিত্তির তুলনায় বাজারের অনেক শেয়ারের দর কম। কিন্তু তারা বিনিয়োগ করছেন না। এর কারণ হলো, ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি। গত দুই বছরে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় যে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ হয়েছে, তাতে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব বিনিয়োগ তহবিলও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মতো অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বেশি মূল্যে শেয়ার কেনায় বের হতে পারছেন না। ফলে বিনিয়োগ করার মতো যথেষ্ট তহবিলও পাওয়া যাচ্ছে না। আবার প্রত্যেকে পৃথকভাবে ভাবছেন, তার একার বিনিয়োগে বাজার ঠিক হবে না। অনেকে ভাবছেন, বাজার আরও পড়লে সেখান থেকে তার বিনিয়োগ অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত হবে এবং লাভ বেশি হবে। সব মিলে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তা বাজারকে ক্রমাগত নিম্নমুখী করছে।
এক্ষেত্রে আবু আহমেদ মনে করেন, ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদের হার এবং ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের বিপুল অঙ্কের ধারের ফলে সৃষ্ট তারল্য সংকটও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিনিয়োগ না বাড়ার কারণ। তিনি বলেন, বর্তমানে শেয়ারবাজার অস্থিতিশীল। কিন্তু ব্যাংকের আমানতের সুদের হার ১২-১৪ শতাংশ। ফলে ব্যাংকে টাকা জমা রাখাই অপেক্ষাকৃত লাভজনক ও নিরাপদ মনে করছেন প্রায় সবাই।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি শাকিল রিজভী জানান, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বাজার লেনদেনের ৭০ শতাংশ যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে হতো, মাত্র দু'মাসের ব্যবধানে তা ২০ শতাংশে নেমে আসে এবং বর্তমানে তা ১০ শতাংশেরও নিচে। ডিএসই সভাপতি বলেন, এটা স্পষ্ট, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারে যে তারল্য সংকট তৈরি হয়, সে সংকট সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাই ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকে প্রভাবিত করতেন। তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার ফলেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন।
পতন ঠেকাতে উদ্যোগ :গত বছরের ৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া দরপতন ঠেকাতে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পর্যায় থেকে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ কমিয়ে আনতে এবং মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর একক ঋণ গ্রহীতা হিসেবে অতিরিক্ত ঋণ সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চার দফায় সময় বৃদ্ধি, ২০০৯ ও ২০১০ সালে লেনদেন ও শেয়ারদর বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে গৃহীত সব নিয়ন্ত্রণমূলক নির্দেশ প্রত্যাহার, শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগে সুযোগ প্রদান, বিনিয়োগকারীদের টিআইএন নম্বর গ্রহণের বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার, সরকারি কোম্পানির শেয়ার বিক্রির কার্যক্রম পিছিয়ে দেওয়া, বাংলাদেশ ফান্ড নামে ৫ হাজার কোটি টাকার বিশাল বিনিয়োগ তহবিল গঠনসহ সর্বশেষ বাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল গঠনের উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এত উদ্যোগের পরও বাজার ইতিবাচক হচ্ছে না। এর কারণ সম্পর্কে এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, তারল্য সংকট দূর করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগ ফিরিয়ে আনতে না পারায় অন্য কোনো উদ্যোগ কাজে আসছে না। তিনি বলেন, পৃথিবীর সব শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগকারীদের আচরণই বাজারের সামগ্রিক আচরণ নির্ধারণ করে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে ফিরিয়ে আনতে না পারায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে মার্চেন্ট ব্যাংক ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর নিজস্ব মূলধন বৃদ্ধি এবং তহবিল সংগ্রহ করে বিকল্প বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
এ অবস্থায় করণীয় : শেয়ারবাজার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় করতেই হবে। এমনটা জানান বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ। ডিএসইর সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, দরপতন মোকাবেলায় সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা জরুরি। আমরা বারবারই যখন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে ফেরার আহ্বান জানাচ্ছি, তারা তাতে সাড়া দিচ্ছেন না। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় করা না গেলে পরিস্থিতি উন্নয়নে অন্য কোনো উদ্যোগ কাজে আসবে না। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরা কেন বিনিয়োগে ফিরছে না, সে বিষয়টি আগে খুঁজে দেখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কিছু করার থাকলে এখনই করতে হবে

No comments

Powered by Blogger.