সাঈদীর ধর্ম ব্যবসা

কাত্তরে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তার বিভিন্ন 'ওয়াজ মাহফিলে' নারী বিষয়ে নানা কথা বলতেন পুরুষদের আকৃষ্ট করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষার্থীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ হিসেবে করা গবেষণায় এমনই দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী তপন মাহমুদ তার পড়াশোনার স্নাতকোত্তর পর্বে রিসার্চ মনোগ্রাফ হিসেবে ২০০৮ সালে এ গবেষণা করেন।
একাত্তরে হত্যা, লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী ২০টি অপরাধে 'রাজাকার বাহিনীর সদস্য' এবং জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয় সোমবার। অভিযোগে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সাঈদী অন্য সহযোগীদের সঙ্গে বিপদ সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে নিজ বাড়িতে আটকে রেখে নিয়মিত ধর্ষণ করেছেন।
গবেষণার প্রক্রিয়া সম্পর্কে গবেষক বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজের অডিও ক্যাসেট ও সিডি থেকে শুনে ২৮০ মিনিটের ট্রান্সক্রিপ্ট করা হয়েছে। তার পুরো ওয়াজকে কয়েকটি মূল আধেয়তে ভাগ করা হয়েছে।
সাঈদী তার ওয়াজে বলেন, 'মানুষের চোখ খুব নান্দনিক জিনিসকে দেখতে পিয়াসী। এর জন্য ফুলের দিকে মানুষ বেশি তাকায়। ময়লার দিকে তাকায় কম। এটা মানুষের ফিৎরা (স্বভাব)। এটা মানুষের প্রকৃতি। সুন্দর জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া মানুষের ফিৎরা। এ জন্য যাতে আকৃষ্ট না হতে পারে সে জন্য বোরকা সাদামাটা হওয়া উচিত ...।'
গবেষক তপন বলেন, এই উদৃব্দতি থেকে বেশ কয়েকটা বিষয় দেখানো যায়। প্রথমত মানুষ বলতে আসলে পুরুষ বোঝানো হয়েছে। আর নারীকে সুন্দর জিনিস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পুরুষ যেন নারীর প্রতি আকৃষ্ট হতে না পারে সে জন্য তাকে সাদামাটা থাকতে বলা হয়েছে।
সাঈদী তার ওয়াজে বলেন, বোরকা, হিজাব_ এসব হলো পরপুরুষের কুদৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করা। এখন বোরকাটা যদি আকর্ষণীয় হয়ে যায় তাহলে তো সমস্যা। এমন বোরকা পরা উচিত যাতে নজর না পড়ে যায়। যাতে কেউ বারবার না তাকায়। বোরকা পরলে মর্যাদা বাড়ে। বোরকাটা এ জন্য পরবেন যাতে কেউ খারাপ নজরে না তাকায়। কমেন্ট না করে। খারাপ মন্তব্য না করে। সেখানে বোরকাটা যদি সুন্দর ডিজাইন করা হয়, অনেক এম্ব্র্রয়ডারি করা হয় তাহলে ওগুলোর দিকে একবার চোখ পড়লে আবার চোখ পড়ে। মানুষের চোখ খুব নান্দনিক জিনিসকে দেখতে পিয়াসী। এ জন্য ফুলের দিকে মানুষ বেশি তাকায় ...।
আরেক ওয়াজে সাঈদী বলেন, ... একদিন এক মহিলা পুলিশের সঙ্গে এয়ারপোর্টে দেখা হলো। বললাম, মা, তুমি পুলিশ হলা কেন? সে বলল, জাতীয় সম্পদ হেফাজত করতে গভর্নমেন্ট আমাদেরকে পুলিশ বানাইছে। আমি বললাম, মা, আল্লাহ তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছে সেটা হেফাজত করতে ১০টা পুলিশ হিমশিম খায়। আর তুমি করবা জাতীয় সম্পদ হেফাজত!
আরেক ওয়াজে সাঈদী বলেন, নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ স্বাভাবিক। সে জন্য ইসলাম বলেছে তাকে পর্দায় রাখার জন্য। এ জন্য সব ভালো ভালো খাবার আল্লাহ পর্দা করে দিয়েছেন। কলা ভালো খাবার, না মন্দ খাবার? কলাটা আল্লাহ প্যাকেট করে দিয়েছেন না? আনারসটা প্যাকেট করে দিয়েছেন না? লিচুটা প্যাকেট করেছেন না? ... সবরি কলা, ল্যাংড়া আম, কাঁঠাল সব ছিলাইয়া যদি বায়তুল মোকাররমের সামনে নিয়া বসে, কেউ কিনবে? কিনবে না তা-ই না। এর ওপর পড়বে মাছি। সুতরাং জিনিস যত ভালো আল্লাহ তাকে পর্দা করে রেখেছেন। নারী হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কে বলেছেন? আল্লাহর রাসুল বলেছেন। এ শ্রেষ্ঠ সম্পদকে আল্লাহ হেফাজত করতে বলেছেন।
কেন এ গবেষণা :গবেষণার ভূমিকায় তপন মাহমুদ লেখেন, তিনি [সাঈদী] আসলে কী বলেন ওয়াজে? কীভাবে উপস্থাপন করেন? তার এই ওয়াজ কী ধরনের সামাজিক অর্থ তৈরি করে_ এসব প্রশ্নকে সামনে রেখে গবেষণাটি করা হয়েছে।
'দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজের আধেয় বিশ্লেষণ' শিরোনামের গবেষণায় সাঈদীর ওয়াজের তিনটি অডিও ক্যাসেট ও দুইটি সিডির বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করেন তিনি। এগুলো হলো_ স্বামী-স্ত্রীর অধিকার (অডিও ক্যাসেট), ইসলামে নারী ও অমুসলিমের অধিকার (অডিও ক্যাসেট), মুমিনের গুণাবলী (অডিও ক্যাসেট), পর্দা :মর্যাদা ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি (ভিডিও ক্যাসেট), জিহাদের মূল প্রেরণা (ভিডিও ক্যাসেট)। এতে দেখা গেছে, ২৮০ মিনিটের ওয়াজে ১১৬ মিনিট সাঈদী কথা বলেছেন নারী প্রসঙ্গে। শতকরা হিসাবে যা ৪১ দশমিক ৭৬ ভাগ।
গবেষণায় দেখা গেছে, সাঈদীর ওয়াজের বিষয়বস্তু হিসেবে থাকে দোয়া (শুরু), মোনাজাত (শেষে), নারী বা স্ত্রী বিষয়ক আলোচনা, মুসলিম জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গ, রাজনীতি প্রসঙ্গ, অমুসলিম প্রসঙ্গ, ধর্মীয় আইনকানুন ও প্রথা, ইসলামী প্রতিপক্ষ সম্বন্ধীয় আলোচনা, হামদ-নাত-ইসলামী গান।
তপন মাহমুদ বলেন, বিশ্লেষণে দেখা গেছে, 'জিহাদের' মূল প্রেরণা বিষয়ক আলোচনাতেও নারী বিষয়ে ব্যাপকভাবে বলা হয়েছে। পুরুষ দর্শককে আকৃষ্ট করা জন্য, বিনোদন দিতে বিষয়টিকে বেশি বেশি আলোচনা করা হয়_ মন্তব্য করেন তিনি। সাঈদী ওয়াজে ধর্মের মোড়কে আসলে এক ধরনের উত্তেজনা ছড়ান সমাজে।

No comments

Powered by Blogger.