সিজারিয়ানে কাবু দেশ, ঝুঁকিতে মা-শিশু by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে শিশু জন্মের হার দিন দিন বাড়ছেই। সিজারিয়ানে কাবু গোটা দেশ। এতে ঝুঁকিতে থাকে মা ও শিশু। আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন সম্প্রতি এক গবেষণায় বলেছে, গত দুই বছরে বাংলাদেশে অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান অপারেশনে সন্তান জন্মদান বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৫১ ভাগ। এর ফলে রোগীরা বছরে খরচ করছেন ৪৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বর্তমানে সিজারিয়ান অপারেশনে জন্ম হয় মোট শিশুর শতকরা ৮০ ভাগ।  এর কারণ মেডিকেল খাতে দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য বিবেকবর্জিত চর্চা। সিজারিয়ান অপারেশনের এই ধারাকে বিশাল বৃদ্ধি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সংস্থাটি। ২০১৮ সালে সিজারিয়ান অপারেশন করানো হয়েছে প্রায় ৮ লাখ ৬০ হাজার নারীর।
এর মধ্যে শতকরা ৭৭ ভাগ অপারেশন করানো হয়েছে একেবারে খালি খালি। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৭০ হাজার। পক্ষান্তরে প্রায় ৩ লাখ নারীকে প্রতি বছর সিজারিয়ান অপারেশন করানো একেবারে বাধ্যতামূলক। তারা এই সুবিধা নিতে পারেন না।
২০০৪ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সিজারিয়ান অপারেশস শতকরা ৪ ভাগ থেকে ৩১ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে সেভ দ্য চিলড্রেন এই খাতকে উন্নততর নিয়ন্ত্রণ, ডাক্তারদের ওপর চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স আরোপের আহ্বান জানিয়েছে। এ বিষয়ে সংস্থাটির ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. ইশতিয়াক মান্নান বলেছেন, এই অপারেশন খুব বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অধিক থেকে অধিক হারে ধনী মায়েরা অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য ভিড় করছেন। তাদের বিশ্বাস, এই অপারেশন তাদের জন্য অধিক স্বস্তির হবে। অথবা হতে পারে, তাদেরকে ভুল বুঝিয়েছেন কোনো চিকিৎসক। পক্ষান্তরে দরিদ্র অনেক নারী, যাদের একান্তই এই অপারেশন দরকার তারা এই সুবিধা পাচ্ছেন না। বিষয়টি বিস্ময়কর। ড. মান্নান বলেন, স্বাভাবিক সন্তান জন্মদানের চেয়ে সংশ্লিষ্টরা অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেয়াকে বেছে নেন আর্থিক সুবিধার জন্য। যদি এক্ষেত্রে কোনো ভুল অথবা ত্রুটিপূর্ণ পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে তার জন্য তাদেরকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় না। তিনি বলেন, অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশন মা ও শিশু উভয়কেই প্রয়োজন ছাড়া ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। এতে সংক্রমণ, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, অঙ্গহানী, রক্ত জমাট বাঁধা সহ নানা রকম ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে। এ ছাড়া মায়ের অপারেশন পরবর্তী সুস্থ হতেও সময় লাগে বেশি। স্বাভাবিক সন্তান জন্ম দেয়ার সুবিধাটি এর মাধ্যমে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাংলাদেশে স্বীকৃত ধাত্রীর সংকট। সারাদেশে মাত্র ২৫০০ এমন ধাত্রী আছেন। সম্প্রতি স্বাস্থ্যখাত থেকে এখাতে ২২ হাজার ধাত্রী প্রয়োজন বলে পর্যালোচনায় বলা হয়েছে। কিন্তু যা আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র এক দশমাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছে, সিজারিয়ান সেকশন এখন দেশের বেশির ভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতা রোধ তো করা যাচ্ছেই না, বরং দিন দিন প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কোনো প্রসূতি পেলেই প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর এক শ্রেণীর চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই বিভিন্ন অজুহাতে রোগীকে নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে কৌশলে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। এমনকি সিজার না হলে মা কিংবা নবজাতকের ক্ষতি হওয়ার ভয়ও দেখানো হয় অনেক ক্ষেত্রে। নিরুপায় হয়ে প্রসূতি ও তার স্বজনরা নিরাপদ মাতৃত্ব ও সুস্থ সন্তানের স্বার্থে হাসপাতালের প্রত্যাশায় সায় দেয়। আর সিজারিয়ানের মাধ্যমে প্রসব পদ্ধতিতে রাজি হলেই শুরু হয় টাকা হাতানোর হিসাব কষাকষি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাভাবিক প্রসবের খরচ সর্বোচ্চ তিন হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা এবং অস্ত্রোপচারে খরচ সর্বনিম্ন ১৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। এর বাইরে কেবিন ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই। সরকারি জেলা হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবের সময় রোগীর পক্ষকে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার ওষুধ কিনলেই চলে, আর অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে কিনতে হয় কমপক্ষে তিন হাজার টাকার ওষুধ। দেশে অনেক নারীর নিজ ও পরিবারের সদস্যেদের ইচ্ছায়, কেউবা চিকিৎসকের কথায় বিশ্বাস করে বা প্ররোচণায় পড়ে সিজারিয়ানের মাধ্যমে শিশু প্রসব করছেন। সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্ম বাড়ছে। এতে শীর্ষে রয়েছেন শিক্ষিত ধনী শ্রেণীর যুবতীরা। ২০১৭ সালের ১০ই আগস্ট সিজারিয়ান (অস্ত্রোপচার) মাধ্যমে শিশু খাদিজার জন্ম হয় মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় একটি বেসরকারি ক্লিনিকে। আত্মীয়-স্বজনের ইচ্ছা ছিল স্বাভাবিক প্রসবের। কিন্তু চিকিৎসক ও ক্লিনিকের দালালদের প্ররোচনায় মা সালমা শেষ পর্যন্ত সিরাজর করতে বাধ্য হলেন। এটি তার প্রথম সন্তান। তার স্বামী থাকেন সৌদিতে। শিশুটির মামা আলাপকালে জানান, তাদের ইচ্ছা ছিল বোনের বাচ্চা যেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়। কিন্তু তা হলো না চিকিৎসক ও ক্লিনিকের কর্মচরাীদের কারণে। সিজার করতে গিয়ে সবমিলে এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে তাদের।
‘মাতৃমৃত্যু ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবা জরিপ ২০১০’ চিত্রে দেখা যায়, ২০০৯ দেশে চার লাখের বেশি শিশু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিল। ২০০১ সালের তুলনায় এই সংখ্যা পাঁচ থেকে ৬ গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার দরকার হয়। মায়ের অপুষ্টি ও গর্ভকালীন সমস্যার কারণে প্রসবে জটিলতা দেখা দেয়। মা ও নবজাতকের প্রাণ ও স্বাস্থ্যরক্ষায় অস্ত্রোপচার করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সিজারিয়ানে শিশু জন্ম বাড়ছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস)-২০১৪-এর তথ্য মতে, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে মাধ্যমে  শিশু  জন্মের বাড়ার গতি ২০০৪ সালে ছিল ৪ শতাংশ, ২০০৭ সালে ছিল ৯ শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল ১৫ শতাংশ আর ২০১৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশ। এতে ৮ শতাংশ অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে শিক্ষিত ও ধনিক শ্রেণীর মধ্যে অস্ত্রোপচারের হার বেশি। দরিদ্র পরিবারে ৭ শতাংশ সিজারিয়ান করান। সরকারি হাসপাতালে ৩৪ শতাংশ, ৮০ শতাংশ লাভজনক প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে, ২৪ শতাংশ এনজিও প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমের শিশু জন্ম দিচ্ছেন। ২০১৭ সালের ২রা মার্চ জাতীয় সংসদে লিখিত প্রশ্নের জবাবে সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছিলেন, দেশে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে তুলনামূলকভাবে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার অনেক বেশি।
এ প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. ফেরদোসৗ ইসলাম বলেন, সিজারিয়ানের মাধ্যমে শিশু জন্ম প্রসবের প্রবণতা বাড়ছে। এটা শিক্ষিত নারীদের মধ্যে বেশি। তার হাসপাতালে বছরে যত শিশু জন্ম হয়, তামধ্যে ৫০ শতাংশই হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। মায়েরা ব্যথা সহ্য করতে চান না। নতুনদের মধ্যে প্রবণতা বেশি। চিকিৎসকরাও অনেক সময়ে ঝুঁকি নিতে চান না।

No comments

Powered by Blogger.