দেবদেবীর মূর্তি, পাথরের নক্সাখচিত দরজা শিলালিপি- সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে গাইবান্ধার প্রত্নসম্পদ by আবু জাফর সাবু

সংরণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে গাইবান্ধার ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং অতীত স্মৃতি বিজড়িত অনেক প্রত্মসম্পদ ও পুরাকীর্তি। অথচ এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন নজর নেই।
ঐতিহাসিক নিদর্শনের অন্যতম হলো : গোবিন্দগঞ্জের বর্ধনকুঠি ॥ সংরণের অভাবে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক বর্ধনকুঠির পুরাকীর্তি এবং সংলগ্ন বাসুদেব মন্দির বিলুপ্ত হতে চলেছে। গোবিন্দগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ চত্বরে মোগল আমলের এই ঐতিহাসিক নির্দশন অযত্ন অবহেলায় ইতোমধ্যে অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। বাসুদেব মন্দিরের সামান্য কিছু জরাজীর্ণ এবং রাজবাড়ির কিছু অংশ ঝোপ জঙ্গলে পূর্ণ হয়ে কোন রকমে তার অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করে টিকে আছে। স্থানীয় লোকজন এসব পুরাকীর্তির প্রাচীন ভবন ভেঙ্গে ইটগুলো পর্যনত্ম নিয়ে গেছে। অথচ দেখার কেউ নেই।
জানা গেছে, গাইবান্ধার ইতিহাসের সঙ্গে গোবিন্দগঞ্জের বর্ধনকুঠি রাজবংশের সমৃদ্ধ ইতিহাস আলোচনা করা একানত্ম অপরিহার্য। ইদ্রাকপুর পরগনা ছিল এতদঞ্চলের মধ্যে এক বিশাল পরগনা। এই পরগনার সদর দফতর ছিল গোবিন্দগঞ্জের বর্ধনকুঠিতে। চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে রাজা রাজন্দ্র নারায়ণ ইদ্রাকপুর পরগনা দখল করে তাঁর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। রাজেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন দেব বংশীয় এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশের জমিদার বংশের লোক। রংপুরের কালেক্টর গুডল্যাডের ১৭৮১ সালের ইদ্রাকপুর সম্পর্কিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, রাজেন্দ্র নারায়ণ থেকে আর্যাবর পর্যনত্ম ১৪ জন জমিদার বা রাজা বর্ধনকুঠির শাসন মতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তারপর আর্যাবরের পুত্র রাজা ভগবান এবং তার পুত্র রাজা মনোহর বর্ধনকুঠির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। রাজা মনোহর নাবালক পুত্র রঘুনাথকে রেখে মৃতু্যবরণ করলে বাংলার সুবেদার শাহ সুজার আমলে মধুসিংহ নামে পার্শ্ববতর্ী এক জমিদার বর্ধনকুঠির পাঁচআনা অংশ দখল করে নেন। পরে ১৬৬৯ সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের এই সনদ মোতাবেক রংপুরের মাহীগঞ্জ, স্বরূপপুর (রংপুর-সৈয়দপুরের মধ্যবতর্ী স্থান) এবং দিনাজপুর জেলার পলাদশী নামের পরগনা গোবিন্দগঞ্জের এই বর্ধনকুঠির আওতায় আসে। ১৯৪৭ সালে ইতিহাসখ্যাত বর্ধনকুঠির সর্বশেষ রাজা শৈলেশ চন্দ্র ভারতে চলে যান। বর্ধনকুঠির অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ত সাগর, দুধ সাগর, সরোবর নামের বিশাল পুকুর, বাসুদেব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, শুলঘর এবং রাজার বসতবাড়ি, ধ্বংসাবশেষের সামান্য কিছু গোবিন্দগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ এলাকায় এখনও বিদ্যমান । তবে প্রয়োজনীয় সংরণের অভাবে এবং কলেজ কর্তৃক ঐতিহাসিক নির্দশনসমূহ বিনষ্ট করে নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করায় অতীতের স্মৃতির ঐতিহাসিক চিহ্নসমূহ এখন বিলুপ্তপ্রায়।
রাজা বিরাট ॥ গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় রাজাহার ইউনিয়নের বিরাট নামের অঞ্চলটির সঙ্গেই এ জেলার গাইবান্ধা নামটির সংশিস্নষ্টতা রয়েছে। কথিত আছে হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যান মহাভারতের পঞ্চ পা-ব কৌরবদের চক্রানত্মের শিকার হয়ে ১২ বছরের বনবাস শেষে ১ বছরের অজ্ঞাতবাসকালে মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের রাজধানীতে ছদ্মবেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পঞ্চপা-বের স্মৃতিবাহী রাজধানী রাজা বিরাট 'গাইবান্ধা' নামকরণের েেত্র বিরাট রাজা ও পঞ্চপা-বের সংশিস্নষ্টতা আছে বলে কিংবদনত্মি রয়েছে। অনেকের মতে, গাইবান্ধা এলাকায় বিরাট রাজার গোশালা ছিল এবং পঞ্চপা-বের শেষ দুই ভাই নকুল ও সহদেব গোশালাটি রণাবেণ করতেন। ওই গোশালা (গাভী-গাই) থেকেই গাইবান্ধা নামকরণ হয়েছে বলে একটি ধারনা প্রচলিত আছে।
এখানে অনেক উঁচু উঁচু মাটির ঢিবি ছিল যা খনন করে প্রাচীন অনেক অট্টালিকা নির্দশন আবিষ্কৃত হয়। প্রত্যদশর্ীর বিবরণে জানা গেছে, রাজা বিরাট এলাকায় খননকালে যে সমসত্ম প্রাচীন অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয় সেই ইটগুলো থেকেও এলাকাটির প্রাচীনত্বের প্রমাণ মেলে। এখানে খননকালে অনেক দেবদেবীর মূর্তি, পাথরের নকশা খচিত দরজা এবং বিভিন্ন শিলালিপি পাওয়া যায় যা বগুড়ার মহাস্থান জাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশাল বিশাল মাটির ঢিবি খুঁড়ে সুগভীর পরিখাবেষ্টিত ২৭টি ধ্বংসস্তুপ খনন করে দরবারক, রাজমন্দির, অতিথিশালা, নাট্যশালা ইত্যাদির সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলোর অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। স্থানীয় লোকজন প্রশাসনের সহযোগিতায় মাটির উঁচু ঢিবি কেটে বিরাট এলাকায় একটি বাজার এবং স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে।

No comments

Powered by Blogger.