গ্লানিমুক্তির প্রশ্ন by মাসুদ মজুমদার

সরকার ও মহাজোটের মুখরা মন্ত্রী এবং নেতারা ছাড়া বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। এখন নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
দেশী-বিদেশী সব মানবাধিকার সংস্থা এ জন্য সরকারের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। দায়ী করছে সরকারকে। সরকার এখন অভিযুক্ত। বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বাকপটু মানুষ। কথার তোড়ে মন ভরাতে চান। বাস্তবতা আড়াল করতেও বাকচাতুর্যের আশ্রয় নেন। তিনি সরকারের ঠিকাদার মানুষ। বর্ণ নীল। অর্থাৎ দলীয় পরিচয়ে তিনি একজন সরকারপন্থী শিক্ষক। এই পদ-পদবিটিও জুটেছে সেই সুবাদে। তিনি যখন সত্য আড়াল করে বক্তব্য দেন, তখন মনে হয় রাজনীতিবিদদের মধ্যেও তিনি তৃতীয় সারির লোক। কখনো কখনো অপরিমিতিবোধ তাকে দলীয় ক্যাডারের স্তরে নামিয়ে দেয়। আজ পর্যন্ত তিনি কোনো একটি ভালো কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেননি। লিমন নিয়ে মায়াকান্না ছাড়া আর কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য কিছু তিনি করেননি। সিলেটে গিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া জেলে ঢুকবার মতো এক কৌতুক নাটক মঞ্চস্থ করে সবাইকে হাসিয়েছেন। সম্ভবত মানবাধিকার সম্পর্কে তিনি কম বোঝেন, কিংবা বুঝলেও সরকারের কুদৃষ্টিতে পড়ার ভয়ে সক্রিয় কর্মীর চেয়েও আগবাড়িয়ে আনুগত্য প্রদর্শন করেন। তিনি এখন মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্নদেরও মানবাধিকার শেখাচ্ছেন। গায় মানে না আপনি মোড়ল সেজে করিৎকর্মা সাজা এবং জনগণের গাঁটের টাকা শ্রাদ্ধ করাই যেন তার কাজ। তিনি নিজেই বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে ছেড়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির ভাবমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার দায় তারও।

বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির যে চরম অবনতি হয়েছে তা আবারো বলে দিয়েছে নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তাদের বার্ষিক রিপোর্টে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের কথা বলা হয়েছে। কিছু অভিযোগ একেবারে সুনির্দিষ্ট। ২০১২ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর তৈরি করা এ রিপোর্টটি গত শুক্রবার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। ৬৬৫ পৃষ্ঠার এ রিপোর্টে ৯০টিরও বেশি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা হয়েছে। সেখানেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলো তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী মহল ও সব বিরোধী দল তাতে বাস্তবতার প্রতিফলন লক্ষ করেছে। সরকার জবাব দেয়ার মতো দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি। বড়গলায় অস্বীকারও করতে পারেনি।

রিপোর্টের নির্যাস হচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করেনি কিংবা করতে পারেনি। মানবাধিকারকর্মী ও সমালোচনাকারীদের জন্য উদার পরিবেশও সৃষ্টি করেনি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মতায় এলেও তা বাস্তবায়নে কোনো রকমের উদ্যোগ নেয়নি, বরং বিচার-আচারে দলীয় মেজাজ বাড়িয়ে তোলা হয়েছে।

অন্য দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত প্রথম রায়টির বিরুদ্ধেও বিশ্বসম্প্রদায় আপত্তি জানিয়েছে। আমরা যারা ভাবছি গ্লানি মুক্তির রায়Ñ সেটা কিনা বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফসল। তা ছাড়া সেই রায় কার্যকর না করা এবং অন্যান্য বিচারকাজ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে নিরপেক্ষ আইনবিদ ও মানবাধিকার কর্মীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল জুরিস্টস ইউনিয়ন। একই সাথে সংস্থাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে হস্তান্তরেরও কথা বলে দিয়েছে।

বাংলাদেশে এ সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদলের সফর নিয়ে সরকার ও সরকারের আনুগত্যবাদীদের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এর জের ধরে বাংলাদেশের মিডিয়ায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদেরকে তুর্কি প্রতিনিধিদল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সফরের পর প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে তাদের সফর অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে প্রণীত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, রোম স্ট্যাটুতে স্বাক্ষরকারী দেশ হওয়ায় ফাঁসির আদেশসংক্রান্ত মামলাটি বাংলাদেশকে অবশ্যই আইসিসির কাছে পাঠাতে হবে। তাদের মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণের সাথে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো। যেমনটি আমাদের দেশের অনেক প্রাজ্ঞ আইনজীবীর বক্তব্যের প্রতিধ্বনিও।

তাদের বক্তব্য হচ্ছে, চলমান বিচারপ্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হচ্ছে না। এতে বিচারক, কৌঁসুলি, তদন্ত কমিটিÑ সব কিছুই বর্তমান সরকার নিয়োগ করেছে। আসামিরা সরকারবিরোধী দু’টি ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য। এমন এক অবস্থায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বিচারকাজ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল এর কোনো সদুত্তর দেয়নি। কেন দেয়নি তাও বোধগম্য নয়।

ইন্টারন্যাশনাল জুরিস্টস ইউনিয়ন আরো বলেছে, রোম স্ট্যাটুর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ যদি বিষয়টি আইসিসির কাছে না পাঠায় কিংবা নিরপেক্ষ বিচারকাজ নিশ্চিত না করে, তবে জাতিসঙ্ঘ তদন্ত কমিশন গঠন করতে পারে। ওই কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়টি রোম স্ট্যাটুর ধারা ১৩(খ) বলে আইসিসির কৌঁসুলির কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্তও নিতে পারে। ফলে আমরা আবেগের আতিশয্যে গ্লানি মোচনের বিষয় ভাবলেও এর জের অনেক দূর গড়াতে বাধ্য।

আমরা নিশ্চিত করে জানি, ৩২টি দেশের আইনবিদ ও মানবাধিকার কর্মীদের নিয়ে আইজেইউ গঠিত। এই ইউনিয়ন গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের আইটিসির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। তারা ২০ ডিসেম্বর ঢাকায় পৌঁছে পাঁচ দিন অবস্থান করে। তারা এ সময় আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, প্রধান কৌঁসুলি, প্রধান বিরোধী দল, বার সভাপতি, তদন্তকারী কমিটির এক সদস্য ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১-এ গিয়ে নতুন করে বিচার শুরুর আবেদনের শুনানিও প্রত্যক্ষ করেন। ফলে তাদের বক্তব্যকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের বক্তব্যের সাথে গুলিয়ে ফেলা সমীচীন হবে না। এই সংস্থার বক্তব্য উপেক্ষা করার একটা সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক পরিণতি অবশ্যম্ভাবী।

নিশ্চিত করে বলা যায় আইজেইউর সাথে পরামর্শ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বক্তব্য দেয়নি। বাংলাদেশের বিরোধী দল কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের সাথে আঁতাত করেও সংস্থা দু’টি রিপোর্ট দেয়নি। মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে, সরকার দেশের রাজনৈতিক ও সুশীলসমাজের কর্মকাণ্ডও সীমিত করে দিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘনের পরও সরকার নিরাপত্তা বাহিনীকে বিচারের মুখোমুখি করেনি, বরং রা করছে। গুম ও হত্যার তদন্ত করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া সরকার এনজিও নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর আইন করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দৃষ্টিতে আইজেইউর মতোই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়াও ত্রুটিপূর্ণ। তারা আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিচারের ল্েয আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে সংশোধন করতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত রাষ্ট্রদূত স্টিফেন র‌্যাপ এবং আরো কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যে দাবি জানিয়েছে তা সরকার আমলে নেয়নি। একই রিপোর্টে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির কথাও রয়েছে। আমাদের অর্থমন্ত্রী সংসদে দুর্নীতির অভিযোগ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। একবারও ভাবলেন না বিশ্বব্যাংকের সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলোর পর দুদকও দুর্নীতির স্বীকৃতি দিয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, গত বছর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কিছু কমলেও ‘ক্রসফায়ার’-এর নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং বিরোধী দলের সদস্য ও রাজনৈতিক কর্মীদের গুম হওয়ার ঘটনা থামেনি। এক সময় আওয়ামী লীগ অঙ্গীকার করেছিল তারা র‌্যাবের সব কর্মকাণ্ড জবাবদিহিতার আওতায় আনবে। এখন পর্যন্ত সেটি বাস্তবে ঘটেনি। গার্মেন্টশ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে অপহরণের পর হত্যা এবং অন্য শ্রমিক নেতাদের হুমকির ঘটনাও সরকার বিশ্বাসযোগ্যভাবে তদন্ত করেনি। সুশীলসমাজ ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর চাপ ও নজরদারি বেড়েছে। তবে  সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের অসম্মান করার বিষয়টি এবারের রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে নেই।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্মরণ করিয়ে দিলো, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভার নিখোঁজ রহস্য উদঘাটনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশকে নির্দেশ দিলেও তার পূর্বাপর কথার ভেতর সঙ্গতি ছিল না। মানবাধিকার সংস্থাটির অভিমত হচ্ছে, পরণেই প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, সরকারকে বিব্রত করতে ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভার আত্মগোপন করেছেন বিএনপির নির্দেশে। তা ছাড়া এক বছরে ২০ বাংলাদেশী গুম হওয়ার তথ্য রয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে, এ কথাও তারা জানিয়ে দিয়েছেন।

তা ছাড়া ২০০৯ সালের বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআরের হত্যাকাণ্ড পরিস্থিতির ওপর গত বছরের জুলাই মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট তৈরিতে যারা সহায়তা করেছিলেন, তাদেরকে সরকারের প থেকে হুমকি দেয়া হয়েছে বলে একটি নতুন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে সংস্থাটি। এই হুমকির তথ্যটি বাংলাদেশের মানুষ এভাবে সুনির্দিষ্ট করে জানত না।

মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে গত বছর মুসলমান রোহিঙ্গাদের সাথে বৌদ্ধদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। তখন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করলে সরকার আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতা অগ্রাহ্য করে তাদের যে মানবাধিকার অগ্রাহ্য করেছে তাও প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে।

ক্রমবর্ধমান সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিক দেউলেপনার বিষয়টিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিবেচনায় নিয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে বাংলাদেশে কঠোর আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। দেশে ধর্ষণ, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, এসিড নিপে, যৌন হয়রানি, ফতোয়ার নামে অন্যায় শাস্তি দেয়াসহ নানা ধরনের পারিবারিক নির্যাতন যে অব্যাহত রয়েছে তার দালিলিক তথ্যও প্রতিবেদনে রয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল জুরিস্টস ইউনিয়ন নিরপেক্ষ বিচারকাজ নিশ্চিত করার জন্য ১২টি বিষয় উল্লেখ করেছে। তাদের ভাষ্য হচ্ছে, মামলা অবশ্যই রাজনীতিমুক্ত হতে হবে। কেবল আইনগত ভিত্তিতেই সেটি পরিচালিত হতে হবে। আইসিটির অপরাধগুলোর সুস্পষ্ট সংজ্ঞা থাকতে হবে। নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে নতুন করে বিচারক নিয়োগ করতে হবে। আইনবিদদের নিয়ে গড়া একটি নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ করতে হবে। অনুপস্থিত বিচারকের সব সিদ্ধান্ত বাতিল করে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মামলার অন্য বিচারক এবং কৌঁসুলিদের সরিয়ে তাদের স্থানে নতুন বিচারক ও কৌঁসুলি নিয়োগ করতে হবে। যেসব কর্মকর্তা তাদের কর্তৃত্বের অপব্যবহার করেছেন, তাদের ব্যাপারে তদন্ত করতে হবে। দেশীয় আইনে অন্যান্য আসামিকে যেসব সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়, এই মামলার আসামিদেরও সেসব সুযোগ দিতে হবে। ক্ষমতা বিভাজনের নীতির ভিত্তিতে বিচার বিভাগকে অবশ্যই রাজনৈতিক চাপমুক্ত করতে হবে। যারা বিচার বিভাগকে চাপে রেখেছে, তাদের ব্যাপারে তদন্ত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ডের আলোকে বিচারকাজ হতে হবে। বিচারকার্যক্রমকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। আইজেইউর বক্তব্যে বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষের চিন্তার প্রতিফলন রয়েছে। তা ছাড়া আমাদের দেশের জনগণ বিচার চায়। একজন লোকও নেই যে বিচার চায় না। তবে বর্তমান বিচারপ্রক্রিয়া যে প্রশ্নবিদ্ধ সে ব্যাপারে গরিষ্ঠ মানুষ একমত। আইজেইউর ১২ পরামর্শ বা অভিমত মেনেই বিচার চলুকÑ অপরাধী শাস্তি পাক এ প্রশ্নে কারো দ্বিমত নেই। তবে নিরপরাধীকে অপরাধী সাজানোর পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য।

আমাদের জানা মতে, জুরিস্টস ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলটির ঢাকা ত্যাগের পরপরই আইনমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিনিধিদলটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছিলেন। তার জবাবে আইজেইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অন্য যেকোনো দেশের মতোই অলঙ্ঘনীয়। তবে সার্বভৌমত্বের সমসাময়িক ধারণায় বলা হয়েছে, কোনো রাষ্ট্র তার ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তাদের নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করার ক্ষেত্রে সীমাহীন কর্তৃত্বের অধিকারী নয়। এ কারণে যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হোক না কেন, বিশ্বসম্প্রদায় তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করবেই। তা ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক সরকারই বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থের ব্যাপারে নীরব থাকতে পারে না বা সেটাকে চ্যালেঞ্জহীন থাকতে দিতে পারে না।

সংস্থাটির অভিমত হচ্ছে, তথাকথিত অবাধ, নিরপেক্ষ, ন্যায়, স্বচ্ছ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বিচার হচ্ছে এবং এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় বলে সরকার যে দাবি করে আসছে, তা সম্প্রতি ইকোনমিস্ট এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মিডিয়া স্পষ্টভাবে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে। তা ছাড়া জাতিসঙ্ঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন এবং অন্যান্য সংস্থাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তা ছাড়া আইটিসি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে এবং তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেছে।

সংস্থাটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ব্যাপারে সৎ থাকে, তবে তার উচিত জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিল অনুমোদিত আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করা। এটাকে তারা বাংলাদেশের সচেতন সব নাগরিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার দাবি হিসেবে বিবেচনার পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। স্কাইপ কেলেঙ্কারিতে অনেক অভিযোগ সত্য হিসেবে উঠে আসার পর সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ আরো কমে গেছে।

আমরা লক্ষ করলাম, সরকার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও আইজেইউর প্রতিবেদন নিয়ে কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলো খণ্ডন করে বাংলাদেশের অবস্থানও তুলে ধরেনি। এর অর্থ দাঁড়ায় সরকার বক্তব্য দিতে অপারগ এবং অভিযোগগুলোর সত্যতা অস্বীকার করার মতো দৃঢ় অবস্থান নিতেও সরকার অক্ষম। এই অক্ষমতা জাতির জন্য বিব্রতকর। এবং গ্লানিমুক্তির যে কথা বলা হচ্ছে সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে। আমরা ক্ষমতার লড়াইয়ের রাজনীতি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে যাবো না। তবে অভিযোগগুলোর সদুত্তর না পেলে সরকারকে দায়মুক্ত ভাবার কোনো সুযোগও দেখি না। আমরা বিচার চাইÑ অবিচার নয়। প্রয়োজনে হাজার অপরাধী ক্ষমা পেয়ে যাক, কিন্তু একজন নিরপরাধী যাতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার না হয়ে যান সেটাও নিশ্চিত করার পক্ষে আমরা। রায় ঘোষণার পর পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল রাজনৈতিক কৌশলÑ এর সাথে ন্যায়, ইনসাফ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সম্পর্ক গৌণ। গুণগত কিছু চাইলে আইইউজের পর্যবেক্ষণ এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মন্তব্য বিবেচনায় নিতেই হবে। নয়তো গ্লানিমুক্তির আবেগমথিত উচ্ছ্বাস জাতিকে শুধুই পীড়াদায়ক বিভক্তির দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে। একই ইস্যুর পুনরাবৃত্তি ঘটবে বারবার।

digantaeditorial@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.