আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়- নানা মহলের নানা জিজ্ঞাসা

মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ একজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রথম রায় ঘোষণা করে গত ২২ জানুয়ারি। ট্রাইব্যুনাল-২-এ মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে ঘোষিত এই রায়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে স্বল্পতম কর্মদিবসে তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়।
বিষয়টি অনেকের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। বিশ্বগণমাধ্যমেও এ রায় নিয়ে সমালোচনা দেখা দেয়। উঠে আসে নানা প্রশ্ন, যার মধ্যে অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি। এবার ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। রায়ে বলা হয়েছে, আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে। একটি অভিযোগে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়েছে, দু’টি অভিযোগে যাবজ্জীবন, অপর তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হলে মোট সাজা যাবজ্জীবন রাখা হয়েছে। রায় ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আবদুল কাদের মোল্লা বলেছেন, ‘মিথ্যা মামলায় আমাকে যারা সাজা দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আমি নিজে বাদি হয়ে মামলা করব। সে দিন এদের হাত-পা কথা বলবে। মিথ্যা অভিযোগে আমাকে সাজা দিয়ে বিচারকেই কলঙ্কিত করেছে।’  অপর দিকে রায়ের পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আবদুল কাদের মোল্লার প্রধান কৌঁসুলি ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘আমরা সুবিচার পাইনি। ন্যায়ভ্রষ্ট সরকারের প্রসিকিউশনের আনা প্রতিটি অভিযোগ ডিফেন্স পক্ষ ভিত্তিহীন প্রমাণ করতে সক্ষম হলেও সাক্ষ্যপ্রমাণের বাইরে গিয়ে চরম দণ্ডের রায়টি দেয়া হয়েছে। সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুসারে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে মুক্তি দেয়া উচিত ছিল।’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ফৌজদারি অপরাধের মামলায় সাজা দিতে হলে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকতে হবে। প্রসিকিউশন যে ছয়টি অভিযোগ করেছে এর মধ্যে প্রথম তিনটিতেই প্রত্যক্ষদর্শী কোনো সাক্ষী ছিল না। চতুর্থ অভিযোগ প্রমাণ হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ আমরা যুক্তি দিয়ে ভিত্তিহীন প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। তা সত্ত্বেও আবদুল কাদের মোল্লাকে সন্দেহের ভিত্তিতে সাজা দেয়া হয়েছে। আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা আবেগতাড়িত। আমরা এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের তিনটি রায়ের নজির আদালতে উপস্থাপন করেছিলাম। আদালত রায়গুলোকে সাদরে গ্রহণও করেছিলেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে প্রদত্ত রায়ে তিনটির কোনো অংশই উল্লেখ করা হয়নি। একজন বিচারক বিচার্য বিষয়ের পর্যালোচনা করে রায় দিয়ে থাকেন। তারা আইন তৈরি করতে পারেন না। বিশ্বের অনেক আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংগঠন বলেছে, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অনেক নিচে। সেখানে রায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে আইনকে আন্তর্জাতিক বলা হয়েছে।’ এ দিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, তারা আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চরম দণ্ড তথা ফাঁসির আদেশ প্রত্যাশা করেছিলেন। তা না হওয়ায় তারা এ রায়ে হতাশ হয়েছেন। বলা হচ্ছে, তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না, সংশোধিত ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী দণ্ড দেয়ার পর সাজা বাড়ানোর জন্য এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ নেই। শুধু আসামিকে বেকসুর খালাস দিলেই রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ থাকে। তবে আসামিপক্ষ ৩০ দিনের মধ্যে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ পাবেন। জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পরিচালিত মামলাগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতÑ এমন অভিযোগ শুরু থেকেই রয়েছে। সে জন্য ট্রাইব্যুনালের বিচারে স্বচ্ছতা বিধানে সরকারপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে মর্মে অভিযোগ দেশে-বিদেশে উঠেছে। বর্তমান সরকার চায় বিরোধী দল নির্মূল করতে, এ সমালোচনাও প্রবলভাবে উঠেছে। এ রায়ে কেনো আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হলো না, তাতে অসন্তুষ্ট আওয়ামী লীগ-মহল। ছাত্রলীগ বলছে, এ রায় মানি না, প্রয়োজনে ট্রাইব্যুনাল ঘেরাও করা হবে। ট্রাইব্যুনাল ঘেরাও করে এরা ট্রাইব্যুনালকে কী ধরনের, কী মাত্রায় প্রভাবিত করতে চাইছে তা স্পষ্ট নয়। তারা এর মাধ্যমে হয়তো বাকি মামলাগুলোতে আসামিদের বিরুদ্ধে চরম দণ্ড নিশ্চিত করতে চায়। কেউ কেউ রাজপথ দখল করে আসামিদের ফাঁসিও দাবি করছে। এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করার জন্য যথেষ্ট উপাদান সরকারি দল ও জোট সৃষ্টি করেছে। এতে ন্যায়বিচার বিঘিœত হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ আছে। সব মহলের উচিত আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া। কোন রায়ে কে খুশি, কে অখুশি হবে তা ভাবার অবকাশ বিচারকদের নেই। বিচারকেরা বিচার্য বিষয় আইনের দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করে রায় দেবেন, সেটাই কাম্য। ইতোমধ্যে সরকারের ভূমিকা ও এই বিচার নিয়ে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলোও বিচারকদের বিবেচনায় রাখতে হবে। ইতোমধ্যে রায়ের ব্যাপারে বিচারকদের ওপর সরকারপক্ষের যে প্রবল চাপ সক্রিয় তা-ও ওপেন সিক্রেট হয়ে পড়েছে। না হলে বিচারকদের কেন সরকারি দলের নেতানেত্রীদের উদ্দেশ করে বলতে হবে, ‘ওরা এসে আমাদের চেয়ারে বসুক, আমরা চলে যাই।’ তা ছাড়া আদালত অবমাননায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ও সরকারি দলের অন্যান্য নেতাকে ট্রাইব্যুনালে কারণ দর্শানোর জন্য কেন ডাকা হবে? অতএব ট্রাইব্যুনালকে ঘিরে আর কোনো প্রশ্ন যেন সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। মানুষ দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায়।

No comments

Powered by Blogger.