সম্মেলন নিয়ে গোলাগুলির জেরে দ্বিতীয় দিনে ছাত্রলীগ নেতা খুন- যশোরে দিনভর সংঘর্ষ আতঙ্ক, আ'লীগ কর্মী তপু আশঙ্কাজনক, ৫শ' জনের বিরুদ্ধে মামলা

ছাত্রলীগের কাউন্সিল নিয়ে বিরোধের জের ধরে সদর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রিপন হোসেন দাদা (২৮) খুন হয়েছে। তার বাড়ি সদরের এড়েন্দা গ্রামে।
রবিবার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে শহরে আসার সময় সন্ত্রাসীরা তাকে ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগ শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন চাকলাদার বলেন, ছাত্রলীগের কাউন্সিল নিয়ে বিরোধের জের ধরে এমপি টিটোর ক্যাডাররা তাকে হত্যা করেছে।
নিহত রিপনের চাচা রবিউল ইসলাম হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান, সন্ধ্যার সময় বাড়ি থেকে বের হয়ে শহরে আসার পথে ভেকুটিয়া জামতলা পৌঁছলে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা হাফিজ, ইকবাল ও মিকাইল তাকে গাছি দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যাকারীরা এমপি টিটোর কাছের লোক। জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান বিপু বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় একটি পা ভেঙ্গে যাওয়ায় দেড় মাস ধরে বাড়িতে ছিলেন রিপন। কাউন্সিল উপল েগত শক্রবার তার পায়ের ব্যান্ডেজ খোলা হয়। কাউন্সিলের দিন শনিবার সে প্রথম অধিবেশনে আসে। দলের প্রতি অত্যনত্ম অনুগত রিপন বেশ আলাপী ছিলেন। চলতি কাউন্সিলে রিপন সাধারণ সম্পাদক প্রাথর্ী ছিলেন। যশোরের পত্রপত্রিকায় তিনি বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন। শনিবার সন্ধ্যায় কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশনে তিনি ফয়সাল খানের প েপ্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। ঘটনার পর পরই জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক শাহিন চাকলাদার, জেলা যুবলীগের সাধারন সম্পাদক জহিরম্নল ইসলাম রেন্টু চাকলাদার, জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক মাহমুদ হাসান বিপুসহ শত শত নেতাকমর্ী হাসপাতালে ভিড় জমান। তারা তাৎণিক মিছিল বের করেন। শহরে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নিহত রিপনের পিতার নাম সহিদুল ইসলাম। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে রিপন ছিলেন সবার ছোট। বাবা ব্যবসায়ী।
এ ছাড়া ছাত্রলীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে শনিবার রাতে নজিরবিহীন গোলাগুলি এবং বোমাবাজির পর কোতোয়ালি পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৫শ' জনের নামে থানায় মামলা করেছে। এ পর্যনত্ম কেউ গ্রেফতার হয়নি। শনিবারের ঘটনার জের ধরে রবিবার সারা দিন শহরে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। কয়েক স্থানে আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকমর্ীদের বাড়িতে হামলা চলানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন চাকলাদার। এর মধ্যে তপু নামের এক আওয়ামী লীগ নেতার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে পেটে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রলীগের সভাপতি প্রাথর্ী মুক্ত রবিবার প্রেসকাবে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, সভাপতি প্রাথর্ী বিজু ও সাধারণ সম্পাদক প্রাথর্ী ফয়সালের বয়স ২৯ বছরের বেশি। কিন্তু তাদের সভাপতি ও সম্পাদক করার ঘোষণা দিলে সাধারণ ছাত্ররা মিছিল করে। তখন বোমা হামলা চালানো হয়।
শনিবার দুপুরে যশোর জেলা পরিষদ মিলনায়তনে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন শেষ হয়। এবার সম্মেলনে সংসদ সদস্য খালেদুর রহমান টিটো সমর্থিত প্যানেলে মহিউদ্দিন আহমেদ মুক্ত সভাপতি এবং এসএম হালিম সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা সভাপতি আলী রেজা রাজু ও সাধারণ সম্পাদক শাহিন চাকলাদার সমর্থিত প্যানেলে সভাপতি প্রাথর্ী ছিলেন লুৎফুল কবির বিজু ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল খান। ঢাকা থেকে আসা আওয়ামী লীগের খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক এমপি, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, বর্তমান সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন যশোরের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে শনিবার রাতে দড়াটানার দলীয় কার্যালয়ে বসেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য খালেদুর রহমান টিটো, শাহিন চাকলাদার, শরীফ আব্দুর রাকিব, পৌর মেয়র কামরম্নজ্জামান চুন্নুসহ অন্য নেতারা। এখানে সমঝোতার ভিত্তিতে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা নিয়ে আলোচনা হলেও তা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যনত্ম সিদ্ধানত্ম হয় ভোটাভুটির। সভাপতি প্রাথর্ী লুৎফুল কবির বিজু বলেন, প্রথমে ভোট দেন শার্শার ২৫ কাউন্সিলর। এর মধ্যে তিনি পান ২৫ ভোট। আর তার প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক প্রাথর্ী ফয়সাল খান পান ২৪ ভোট। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা যখন বিজয়ী ঘোষণা করবে, তখন খালেদুর রহমান টিটো সমর্থিত মুক্তর লোকজন বোমা হামলা চালায়। তিনি আরও অভিযোগ করেন, পার্টি অফিসে প্রথম বোমা হামলা চালানো হয় দণি পাশ থেকে, ওই এলাকায় এমপি টিটোর লোকজন ছিল।
প্রত্যদশর্ীরা জানান, বৃষ্টির মতো বোমার সঙ্গে গুলি চালানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশও শর্টগানের গুলি ছোড়ে। কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাদের বেগ জানান, পুলিশ ৬০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। ঢাকা এবং যশোরের নেতারা আটকা পড়ে যান ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত আওয়ামী লীগ অফিসের মধ্যে। পরে পুলিশ প্রহরায় তাদের বাইরে এনে যার যার গাড়িতে তুলে দেয়া হয়। এ সময় গুলি ও বোমার স্পিস্নন্টারে আহত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সম্পাদক শরীফ আব্দুর রাকিব, এমপি খালেদুর রহমান টিটোর পুত্র মাশুক হাসান জয়, কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাদের বেগ, এসআই ইলিয়াস, কনস্টেবল নজরম্নল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের খলিল (৩৫), মিরাজ(২৫), ওমর ফারম্নক সরদার(৩৮), ইলিয়াস(২২), সাজু(২৩), রাজু(২৮), সুমন(২৩), বাপ্পী(২০), সোহেল(২২), প্রতাপ(১৭), রফিকুল(২০), কাঞ্চন(৪৫), রবিউল(৩০), আব্দুল(৪৫), মোতালেব(৩৮), নাসির(৩৫)সহ প্রায় ৫০ জন। এঁরা রাতে যশোর আড়াই শ' শয্যা হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাদের বেগ জানান, শনিবারের রাতের বোমাবাজি এবং গুলি বর্ষণের ঘটনায় দুই পরে অজ্ঞাত ৫শ' জনের নামে মামলা করা হয়েছে। মামলা নম্বর-৫২। মামলার বাদী এসআই মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, তদনত্ম শুরম্ন হয়েছে। কারা শনিবার রাতে বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত তাদের শনাক্ত করে এই মামলায় গ্রেফতার করা হবে।
এদিকে শনিবারের ঘটনায় দু'পরে মধ্যে শহরে এখনও উত্তেজনা বিরাজ করছে। শনিবার রাতে শহর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হাসান ঈমাম লালের বাড়িতে তিনটি শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তার বাড়ি শহরের রেলগেট এলাকায়। তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুসারী মাদক ব্যবসায়ীরা তার বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। জেলা যুবলীগের দফতর সম্পাদক আজহার হোসেন স্বপন ও শহর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনোয়ার হোসেন জনিকে রবিবার সকালে রেলগেটে বাড়ির সামনে মারপিট করেছে হেরোইনখোর মোহর। তারা শাহিন চাকলাদারের কাছের লোক বলে পরিচিত।
রবিবার দুপুরে শহর আওয়ামী লীগের সদস্য রবিউল আজিজ তপু শহরের রেলগেট এলাকার বাড়িতে মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন। রেলগেট শাহরিয়ার হোটেলের সামনে পৌঁছলে মুরগি বাবলু তাকে দাঁড়াতে বলেন। তিনি দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসী লতু তার পেটে ছুরিকাঘাত করে। স্থানীয় মানুষ তাকে উদ্ধার করে যশোর আড়াই শ' শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা গুরম্নতর। ফুসফুস এবং পেটের কয়েকটি নাড়ি কেটে গেছে। হামলার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ট্যারা তপন, সাগর, জেরো বাবুসহ কয়েক সন্ত্রাসী। এরা এলাকায় হেরোইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। জেলা যুবলীগের সম্পাদক জহিরম্নল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু বলেন, মুরগি বাবলু এবং লতু এমপি টিটোর পুত্র মাশুক হাসান জয়ের বন্ধু এবং ছুরিকাঘাত করার পর পুলিশ তাদের ধাওয়া করলে তারা পালিয়ে এমপির বাড়িতে যায়। তবে এমপি টিটোর পুত্র মাশুক হাসান জয় বলেন, বাবলু এবং লতুকে, চিনি তারা আওয়ামী লীগ করে। তারা কেউ তার বন্ধু নয়। আর তপুকে ছুরিকাঘাতের সঙ্গে তারা জড়িত, তাও তিনি জানেন না। শনিবার রাতে তার পায়ে বোমার স্পিস্নন্টার লাগায় তিনি বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন চাকলাদার বলেন, এমপি টিটো এবং রাকিব দলের জেলা কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করছে। তারই অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতাকমর্ীদের ওপর শনিবার রাতে বোমা হামলা চালানো হয়েছে এবং রবিবার দিনভর আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর হামলা চালানো হয়। অন্যদিকে শরীফ আব্দুর রাকিব বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে শনিবার রাতে এই ঘটনা ঘটেছে। তারা মাদ্রাসার নকল সনদধারীদের ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বসাতে চাইছে। সাধারণ ছাত্ররা সেটা চায় না। তারা প্রতিবাদ করলে বোমা হামলা চালানো হয়। জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে সভাপতি প্রাথর্ী মহিউদ্দিন আহমেদ মুক্ত রবিবার যশোর প্রেসকাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, বিজু এবং ফয়সালের বয়স ২৯ বছরের বেশি। তাদের ছাত্রত্ব নেই। কিন্তু শাহিন চাকলাদারসহ অন্য নেতারা তাদের সভাপতি, সম্পাদক করতে চান। কেন্দ্রীয় নেতারা বিষয়টি না বুঝেই তাদের প নেন। এই ঘটনায় তারা প্রতিবাদ করে মিছিল বের করলে তারা বোমা হামলায় চালায় তাদের ওপর।
অন্যদিকে শহর আওয়ামী লীগের সদস্য রবিউল আজিজ তপুকে ছুরিকাঘাতের প্রতিবাদে রবিবার দুপুরে আওয়ামী লীগ শহরে বিােভ মিছিল বের করে। হাসপাতাল থেকে মিছিল বের করে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যান। সেখানে পুলিশ সুপার দিদার আহমেদের সঙ্গে দেখা করে ঘটনার সুষ্ঠু তদনত্ম এবং দোষীদের গ্রেফতারের দাবি জানান।
এদিকে শনিবার রাতেই এই হামলার সময় ছাত্রদল এবং শিবির অংশ নেয় বলে অভিযোগ করেন ছাত্রলীগের সভাপতি প্রাথর্ী লুৎফুল কবির বিজু। তিনি বলেন, ছাত্রদল এবং শিবির এমএম কলেজের আশপাশ থেকে এসে তাদের ওপর বোমা হামলা চালায়। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, যদি এই ধরনের ঘটনা ঘটে তবে তদনত্ম করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখনও শহর জুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

No comments

Powered by Blogger.