যুদ্ধশিশুদের পাশ্চাত্যের অনেক পরিবার দত্তক নিয়েছিল by মুনতাসীর মামুন

একা সেই সময় তিনি যে কাজ করেছেন তা তুলনাহীন। বাংলাদেশের মানুষ এখনো তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। বাংলাদেশের বিজয়ের পরই গণহারে ধর্ষণের বিষয়টি একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেয়।
শুধু মানবিক নয়, সামাজিক- রাজনৈতিকও। যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন প্রধান আকাক্সক্ষা ছিল বেঁচে থাকা। যে কোনো গণহত্যা, ব্যক্তি হত্যা, বন্ধু পরিচিতজনের হত্যার খবর শোনার পর মনে হতো, আরে আমি তো বেঁচে আছি। তখন, ধর্ষণের ঘটনা শুনছি, মনে হয়েছে হত্যা থেকে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটি সবারই কম বেশি মনে হয়েছে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার দিন থেকেই দেখা গেল, বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি অংশ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। চার লাখও যদি ধর্ষিত হয়ে থাকে। তাহলে চার লাখ পরিবার সরাসরি বিপর্যস্ত। কিন্তু এ দেশে একটি পরিবার মানে তো শুধু পিতামাতা আর সন্তানই নয়, চাচা, ফুপু, খালা মামা এবং জ্ঞাতি ভাইবোন সবাই পরোক্ষভাবে হলেও বিপর্যস্ত। তাহলে সংখ্যাটি কী দাঁড়ায়?
সমাজ, রাষ্ট্র এ অবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সমাজে এক দিকে ছিল ঐতিহ্য ও ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুশাসন। যুদ্ধও যা ধ্বংস করতে পারেনি। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রায় অনুপস্থিত। সরকার কোন বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেবে তাও বুঝতে পারছে না। কিন্তু ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের পর যে বিষয়টি গুরুত্ববহ হয়ে উঠছে তা সবাই বুঝতে পারছিল। ডা. ডেভিসের সংবাদ সম্মেলন যার ওপর ভিত্তি করে বাংলার বাণী একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল তা এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্যÑ
“দখলদার আমলে পাকিস্তানী সেনা কর্তৃক ধর্ষিত বাংলাদেশের মহিলাদের একটা বিরাট অংশ বন্ধ্যাত্ব ও পৌনঃপুনিক রোগের সম্মুখীন হয়েছে বলে একজন অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক মত প্রকাশ করেছেন।
সিডনির শল্য চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস সম্প্রতি লন্ডনে বলেন যে, ৯ মাসে পাক বাহিনীদের দ্বারা ধর্ষিতা চার লাখ মহিলার বেশিরভাগই সিফিলিস অথবা গনোরিয়া কিংবা উভয় ধরনের রোগের শিকার হয়েছেন। এদের অধিকাংশ ইতোমধ্যেই ভ্রƒণ হত্যাজনিত অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। তিনি বলেন, এরা বন্ধ্যা হয়ে যেতে পারেন। কিংবা বাকি জীবনভর বার বার রোগে ভুগতে পারেন।
ড. ডেভিস বলেন, বাংলাদেশে কোন সাহায্য এসে পৌঁছাবার আগেই পাকিস্তানী সৈন্যদের ধর্ষণের ফলে দুই লাখ অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাগরিষ্ঠাংশ স্থানীয় গ্রামীণ ধাত্রী বা হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে গর্ভপাত ঘটিয়েছেন। তিনি বলেন, ক্লিনিক্যাল দিক থেকে গর্ভপাত কর্মসূচী সমাপ্ত হয়েছে, কিন্তু মহিলাদের কঠিন সমস্যা এখনও রয়ে গেছে।
ড. ডেভিস বলেন, আমরা বিরাজমান সমস্যা সম্পর্কে অবগত হবার আগেই অনিবার্য ও অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির চাপে দুই লাখ ধর্ষিতার মধ্যে দেড় লাখ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা মহিলা গর্ভপাত করেছেন।
ড. ডেভিসের মতে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা খুবই গুরুতর। বেশকিছু সংখ্যক তরুণী যৌন মিলনের উপযোগী না হওয়ায় সমস্যা বেশি জটিল হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগা মহিলা’রা যদি রোগের চিকিৎসা লাভে সক্ষমও হন তবুও তাদের বিয়ে করার মতো কোন একজনকে খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টকর।”
সামাজিক সমস্যা প্রকট করে তুলেছিল যা বিস্তারিতভাবে ডেভিস উল্লেখ করেছেন। যৌন রোগ এবং অন্তঃসত্ত্বার বিষয়টি। আমাদের কেস স্টাডিগুলোতে দেখা যায়, পুনর্বাসন কেন্দ্রের ক্লিনিকে যারা গেছেন তাদের কিছু গর্ভপাত করাতে পেরেছিলেন। অধিকাংশই পারেননি দেখে ক্লিনিকে এসেছিলেন গর্ভপাত করাতে। একজন মাত্র গর্ভজাত সন্তানকে রাখতে চেয়েছিলেন। সবার গর্ভপাত সম্ভব হয়নি। তাদের সন্তান যুদ্ধশিশু হিসেবে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। কিন্তু ছয় লাখের মধ্যে কয়জন ক্লিনিকে আসতে পেরেছিলেন? সুসান জানাচ্ছেন, এ সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি হবে না।
কলকাতার মাদার তেরেসা যুদ্ধশিশু গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। পুনর্বাসনের জন্য অনেক মহিলাকেও গ্রহণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু তেমন সাড়া পাননি। যুদ্ধশিশুদের যারা বিভিন্ন কেন্দ্রে স্থান পেয়েছিল তাদের পাশ্চাত্যের অনেক পরিবার দত্তক নিয়েছিল। তাদের অনেকে আবার এখন বাবা-মার খোঁজে এ দেশে এসেছেন। ‘নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র’ সহায়তা পেয়েছিল প্যারেন্ট হুডের। তারা ঢাকা শহর ও অন্যান্য জায়গায় ১৭টি ক্লিনিক খুলেছিলেন। খোলার পর প্রথম মাসেই ঢাকা ক্লিনিকে ১০০ জনের গর্ভপাত ঘটানো হয়েছিল।”
কিন্তু কতজন আর ক্লিনিকে আসতে পেরেছেন। অধিকাংশই ছিলেন গ্রামীণ কিশোরী। কখনো বাবা-মা, কখনো মুক্তিযোদ্ধা, কখনো গ্রামের সহানুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তি যারা ক্লিনিকের কথা শুনেছিলেন তারা নিয়ে এসেছিলেন। ডা. জিওফ্রে ডেভিস বাংলাদেশের অনাচেকানাচে ধর্ষিতাদের নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন অনেক নবজাতককে হত্যা করা হয়েছে ইঁদুর মারা বিষ খাইয়ে বা পানিতে ডুবিয়ে। অসংখ্য আত্মহত্যা করেছেন। হাজার পাঁচেকের মতো বিভিন্ন উপায়ে গর্ভপাত করাতে পেরেছিলেন মাত্র।
॥ ছয় ॥
এ রকম সমস্যার সম্মুখীন তো আগে কখনও হয়নি বাংলাদেশের মানুষ। এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় মনে রাখা উচিত। বাংলাদেশের অবকাঠামো তখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। জনসংখ্যার বড় অংশ নিঃস্ব। ভায়োলেন্স, বিশৃঙ্খলা চর্তুদিকে বৃহৎ শক্তিগুলোর বাংলাদেশের প্রতি বিরুদ্ধাচরণ। বাংলাদেশ তখন সম্পদহীন। এ অবস্থায় ধর্ষিতা এবং তাদের পরিবার। বাংলাদেশ এই বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধান যেভাবে করেছে বা করতে চেয়েছে সুসান ব্রাউনমিলার তাকে ‘ইউনিক’ বলে অ্যাখ্যা করেছেন। তাঁর ভাষায়-
“The story of Bangladesh was unique in one respect. For the first time in history the raped women in war, and the complex aftermath of mass assault, received serious international attention. the desperate need of sheikh Mujibur Rahman’s government for international sympathy and financial aid was past of the reason; a new feminist consciousness that encompassed rape as a political issue and a growing practical acceptance of abortion as solution to unwanted pregnancy were contributing factors of critical importance. And so an obscure war in an obscure corner of the globe, to western eyes, provided the setting for and examination of the `unspeakable’ crime. for once, the particular terror of unarmed women facing armed men had full learning.”
১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু গেছেন পাবনা জেলার নগরবাড়ীর উত্তরে বসন্তপুর গ্রামে। সেখানে তিনি উদ্বোধন করবেন মুজিব বাঁধ নির্মাণের কার্যক্রম। এত মানুষ পাবনার আর কোনো জনসভায় হয়নি। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার প্রাক্কালে দেখা গেল একদিকে খানিকটা হৈচৈ হচ্ছে, কয়েকজন মহিলা বঙ্গবন্ধুর কাছে আসতে চাচ্ছেন; কিন্তু তাদের বাধা দেয়া হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন তাদের আসতে দিতে। তারা ছুটে এসে বঙ্গবন্ধুর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। একজন জানালেন, তার খুব সুখের সংসার ছিল। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী তাকে লাঞ্ছিত করে। তার স্বামী এখন তাকে সংসারে নিতে চাচ্ছেন না। আশপাশের মানুষজনও টিটকারি দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শুনলেন।
সবশেষে বঙ্গবন্ধু উঠলেন বক্তৃতা দিতে। প্রথমেই তিনি বললেন, “আজ থেকে পাকিস্তান বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়। তারা এখন থেকে বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত। কেননা দেশের জন্য তাঁরা ইজ্জত দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে তাদের অবদান কম নয়, রবং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাদের বীরাঙ্গনা মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে। আর সেই স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশে আমি বলছি যে, আপনারও ধন্য। কেন না এ ধরনের ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা মেয়ের পিতা হয়েছেন।”
অধিকাংশ বর্ণনায় আছে, ওই দিন থেকে নির্যাতিত মহিলারা বীরাঙ্গনা অভিধায় ভূষিত হন।
পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেছিলেন ১০ জানুয়ারি। আর সিরাজগঞ্জে সভা করেছিলেন ২৬ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এর আগেই বাংলাদেশ সরকার লাঞ্ছিতাদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে ভূষিত করার প্রস্তাব নেয় এবং সংবাদপত্রও শব্দটি ব্যবহার শুরু করে। ৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারী মহিলা মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ জাহানারা করিমের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রস্তাব নেয়া হয় এই বলে যে-
“পাক বাহিনী এবং তার সমর্থকদের অত্যাচারে আমাদের বোনেরা মায়েরা যারা নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের সরকার কর্তৃক ‘বীরাঙ্গনা’ আখ্যান দান করার প্রস্তাবকে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে এবং সমাজে পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে পুনর্প্রতিষ্ঠায় আশু দাবিও জানানো হয়।”
বীরাঙ্গনা নামকরণ এবং সেই সময়কার অনুভূতি যা আমরা আগে কিছুটা উল্লেখ করেছি, তার প্রতিধ্বনি পাই সুলতানা কামালের ভাষায়
“যুদ্ধে যে সমস্ত নারীর ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল, যাদের ধর্ষণ করা হয়েছিল তাদের প্রতি সেই সময়ে যে নির্যাতন করা হয়েছিল, তাদের প্রতি সহানুভূতি এবং তাদের রক্ষা করতে না পারা জাতির জন্য এক অসহায় লজ্জা। অত্যন্ত আবেগাপ্লুত মনোভাব থেকে তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল বীরাঙ্গনা। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্য নারীকর্মীদের ক্ষেত্রেও এই বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের তদানীন্তন মহিলা সাংসদ বদরুন্নেসা আহমদের মৃত্যুতে সংসদে যে শোক প্রস্তাব আনা হয় তাতে তাকেও বীরাঙ্গনা বলে অভিহিত করা হয়। অতএব ‘বীরাঙ্গনা’ বলতে শুধু যে সমস্ত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের বেলায় এ ধারণাও সত্য নয়। উল্লেখ্য, যারা এ সময়ে যুদ্ধাক্রান্ত নরীদের নিয়ে কাজ করেছেন প্রত্যেকেই প্রচ- সহমর্মিতা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। কিন্তু ধর্ষণ যে নারীর বিরুদ্ধে একটি অপরাধ এই ধারাগুলো সে সময় প্রতিষ্ঠা পায়নি। তাই তার বিচার চাওয়ার প্রশ্নটি একেবারেই অনুচ্চারিত থেকে গেছে। বরঞ্চ নির্যাতিত নারীদের নির্যাতনের কথা যতদূর সম্ভব গোপন রেখে তাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংসারে, সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার বিষয়টিকেই অনেক জরুরী বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব ছিল বড় রূঢ়। একটি সময় শুধু ধর্ষিতাদের বীরাঙ্গনা হিসেবে বোঝানো হয়েছে। এবং অনেক সময় শ্লেষাত্মকভাবে এই উপাধি ব্যবহার করা হতো। ফলে, বঙ্গবন্ধু এদের বীরাঙ্গনা বলেছেন বটে কিন্তু বৃহত্তর সমাজ তা গ্রহণ করেনি। এবং বীরাঙ্গনারাও তাতে সান্ত¡না পাননি। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.