যুদ্ধাপরাধের বিচারে ভারত খুশি- ফালানীর বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি

তিস্তা চুক্তি নিয়ে আবারো আশার বাণী শোনালেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব রঞ্জন মাথাই। গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন,
তার দেশের বর্তমান জোট সরকারের মেয়াদপূর্তির আগেই, ‘দ্রুততম সময়’-এর মধ্যেই তিস্তার অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি সই হবে। এ ছাড়া এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ’৭৪-এর সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়নের ব্যাপারে ভারত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ ছাড়া দুই বছর আগে সীমান্তে ভারতের বিএসএফের হাতে নিহত ফালানী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান। গতকাল সকালে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রসচিব মো: শহীদুল হক। এরপর যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সাথে সৌজন্য সাাৎ করেন রঞ্জন মাথাই। যৌথ সংবাদ সম্মেলনের পর বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সাথে তার দফতরে এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সাথে তার বাসায় সৌজন্য সাাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব।

এ দিকে পদ্মা সেতুতে ভারতের অর্থায়ন নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা প্রসঙ্গে রঞ্জন মাথাই না সূচক জবাব দেন। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জানান, বাংলাদেশের প্রস্তাব পেলে সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো পর্যায়ে বৃহৎ প্রকল্পে যুক্ত হতে ভারত রাজি আছে।

এ ছাড়া দুই বছর আগে ভারতের সীমান্তরী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের কিশোরী ফালানী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে তার সুনির্দিষ্ট কিছু জানা নেই বলে মন্তব্য করেন রঞ্জন মাথাই।

সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, ‘বিচারিকপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে অতীতের ত আর বিয়োগান্তক ঘটনার চির অবসান হবে।’

তিস্তা চুক্তির আশ্বাস : দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব যৌথ সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগে দুই দেশের ফরেন সার্ভিস ইনস্টিটিউটের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই করেন। এর আওতায় এক দেশের কূটনীতিকেরা অন্য দেশের প্রশিণ কেন্দ্রে পেশাগত প্রশিণ নেয়ার সুবিধা পাবেন।

এ দিকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার পর অন্য কয়েকটি দেশের পাশাপাশি ভারতকে যুক্ত করার দাবি করা হচ্ছে সরকারের প থেকে।

গতকাল এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রঞ্জন মাথাই বলেন, ‘পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে আমরা এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করিনি। এ প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু এটুকু বলতে পারি, এটা বৃহৎ একটি প্রকল্প। আমি মনে করি না কারো একার পে এ ধরনের প্রকল্প এককভাবে নির্মাণ করা সম্ভব। ১০০ কোটি ডলার ঋণ চুক্তির আওতায় ২০ কোটি ডলার অনুদানের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে আমাদের আলোচনা হয়েছে। ওই টাকা বাংলাদেশ যেকোনো কাজে ব্যবহার করতে পারে। তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে যুক্ত হতে চায় এমন কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা অর্থায়নকারী সংস্থার সাথে যোগ দেয়ার ব্যাপারে আমরা আগ্রহী।’

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো: শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, নিরাপত্তা, স্থল সীমান্ত ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি, পানিসম্পদ, বাণিজ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ এবং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আসন্ন ঢাকা সফর নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

ভারতের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোট (ইউপিএ) সরকারের বর্তমান মেয়াদের (আগামী এক বছর) মধ্যে তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়নের মতো বিষয়গুলোর সুরাহা হবে কি না জানতে চাইলে রঞ্জন মাথাই বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছি স্বল্প ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বিষয়গুলোর সন্তোষজনক সমাধানের জন্য ভারত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ বিষয়ে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ভারত সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। আসলে, আমাদের এক বছর অপো করতে হবে না। যখনই এসবের সুরাহা করাটা বাস্তবিক মনে হবে, তখনই তা করা হবে।

আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবিত দিল্লি সফরে তিস্তা ও সীমান্ত প্রটোকলের সুরাহা হবে কি না জানতে চাইলে, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমি আশাবাদী। আমি জ্যোতিষী নই। তবে আবার আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি, আমরা আমাদের অঙ্গীকার পূরণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রয়েছি। আমি আগেই বলেছি, আমাদের অঙ্গীকারের সাথে দিনপঞ্জির কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা যত দ্রুত সম্ভব প্রতিশ্র“তি পূরণে সচেষ্ট রয়েছি।’

ফালানী হত্যাকাণ্ড নিয়ে জানেন না : এ দিকে দুই বছর আগে ভারতীয় সীমান্তে নিহত ফালানীর বিষয়ে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য দেননি ভারতের পররাষ্ট্রসচিব। যদিও ভারতের প থেকে বিচারের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। ফালানী হত্যায় জড়িত ভারতীয় সীমান্তরী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। দোষী সাব্যস্ত হলে সংশ্লিষ্ট সীমান্তরীদের শাস্তি দেয়া হবে। ওই তদন্তের ফলাফল কি জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শুধু বলেছেন, ‘ওই ঘটনা সম্পর্কে আমার জানা নেই।’

তবে তার অন্য সহকর্মীদের মতো সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশী হত্যাকাণ্ডকে ‘মৃত্যু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন রঞ্জন মাথাই। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রান্তে মৃত্যুর ঘটনা শুধু বাংলাদেশ কেন, ভারতের কাছেও গভীর উদ্বেগের বিষয়। আমাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর আমাদের সীমান্ত এলাকায় ১০ ভারতীয় মারা গেছেন। আমরা আজকের আলোচনায় বলেছি, দুই উপায়ে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রথমত সীমান্তরীরা টহল দেয়ার সময় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকার ব্যাপারে ন্যূনতম ছাড় দেয়া হবে না। সীমান্ত এলাকাকে অপরাধমুক্ত করার স্বার্থেই এটা করতে হবে। আমরা যেসব প্রতিবেদন পেয়েছি, তাতে বলা হয়েছে সশস্ত্র অপরাধীরা সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। এ জন্যই দুই দেশের সরকার সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা সই করেছে। এর আওতায় নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সান্ধ্য আইন জারির সিদ্ধান্ত রয়েছে। এ ধরনের তৎপরতার ফলে রাতে সশস্ত্র সঙ্ঘাতের কারণে দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটছে। তাই অপরাধীদের দমনে আমাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের ল্েয কাজ করছি।

অন্য দিকে একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে চলমান আন্দোলন সমাবেশকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে অভিহিত করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব।

তিনি বলেন, ‘ইতিহাসের সে সময়ের সাী হিসেবে বলতে পারি, শুধু একটি বিচারের ঘোষণার মতো সহজ-সরল কোনো বিষয় এটি নয়। একটি দেশে গণহত্যার মতো নৃশংস ঘটনা সঙ্ঘটিত হয়েছিল, যা দেশটির মানুষের হƒদয়ে গভীর বেদনা ও ত সৃষ্টি করেছে। বিশ্বজুড়ে এ ঘটনার স্বীকৃতি জরুরি।

তিনি বলেন, বিস্তারিত স্যা-প্রমাণ ও তদন্তের ভিত্তিতে বিচারিকপ্রক্রিয়ার অনুসরণ করায় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানাই। দেরিতে হলেও যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়া চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিচারপ্রক্রিয়ার ফলাফল কি হবে সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে অতীতের সেসব ভয়াবহ যন্ত্রণা ও বেদনার অবসান হওয়া উচিত। আর বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর অবসানের উদ্যোগ নেয়ায় আমরা সন্তুষ্ট।’

এছাড়া বন্দিপ্রত্যপর্ণ চুক্তি অনুযায়ী রাজনৈতিক অপরাধী কিংবা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের হস্তান্তর করা যাবে না। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব খুব স্পষ্ট করে বলেননি অনুপ চেটিয়া কোনপর্যায়ে পড়েন। তবে তিনি বলেন, এ আইন অনুযায়ী তাকে হস্তান্তর করা সম্ভব।

No comments

Powered by Blogger.