বর্ধিত চাহিদা মেটাচ্ছে কনজুমার্স ব্যাংকিং -মোখলেসুর রহমান by আশরাফুল ইসলাম

দেশের মানুষের আয় বেড়েছে। পরিবর্তন হয়েছে মানুষের লাইফস্টাইল। আর লাইফস্টাইল পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের চাহিদাও বেড়েছে। বেড়েছে প্রত্যাশা।
আর এ বর্ধিত চাহিদা মেটাচ্ছে কনজুমার্স ব্যাংকিং। ইতোমধ্যে কনজুমার্স ব্যাংকিংয়ের প্রসার লাভ করেছে। ব্যাংকিং খাতে প্রসারিত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির। তাই বর্তমানে কনজুমার্স ব্যাংকিং ছাড়া ব্যাংক কল্পনাই করা যায় না। কনজুমার্স ব্যাংকিং প্রসারের কারণ কনজুমার্স ব্যাংকিংয়ের প্রতিবন্ধকতা ও এর আরো সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়ে নয়া দিগন্তের  সাথে খোলাখুলি আলাপ করেছেন বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংক ইস্টার্ন ব্যাংকের ডিএমডি ও হেড অব কনজুমার্স ব্যাংকিং মোখলেসুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশরাফুল ইসলাম।

নয়া দিগন্ত  : কনজুমার্স ব্যাংকিংয়ের ধারণা কখন থেকে আসে?

মোখলেসুর রহমান : দেশের স্বাধীনতার গোড়ার দিকে ব্যাংকিং বলতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বোঝাত। ’৮০-এর দশকে বেসরকারি খাতে কয়েকটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়। আর এই সুবাদে ব্যাংকিং খাতে নতুন মাত্রা আসে সঞ্চয়ে। তখনও ব্যাংকিং খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া ছিল না। ’৯৪ ও ’৯৫ সালের দিকে তৎকালীন এএনজেড গ্রিনলেজ ব্যাংক ও স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক গ্রাহকের জন্য কনজুমার্স ব্যাংকিং নামক একটি নতুন সেবা নিয়ে আসে, যা পরবর্তীকালে ব্যাংকিং খাতে একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়।

নয়া দিগন্ত : কনজুমার্স ব্যাংকিং কী?

মোখলেসুর রহমান : কনজুমার্স ব্যাংকিং হলো নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন মেটানোর সম্বল। যেমন একজন চাকরিজীবী পরিবারের একটি রেফ্রিজারেটর প্রয়োজন। ধরা যাক ওই ব্যক্তি মাসে বেতন পান ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতি মাসে ঘরভাড়া, সংসার খরচের জন্য ব্যয় হয় ৩৫ হাজার টাকা। হাতে থাকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু তার এখন একটি রেফ্রিজারেটর প্রয়োজন। দাম ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতি মাসে ব্যয় মেটানোর পর অবশিষ্ট থাকে পাঁচ হাজার টাকা। ব্যাংক একটি রেফ্রিজারেটর কেনার টাকা দিলো। গ্রাহক রেফ্রিজারেটর নিয়ে ঘরে এলো। আর গ্রাহক প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে পরিশোধ করল। এক সময় ব্যাংকের টাকা পরিশোধ হয়ে গেল। রেফ্রিজারেটর গ্রাহকের নিজের হয়ে গেল। এটাই হলো কনজুমার্স ব্যাংকিং।

নয়া দিগন্ত : অভিযোগ আছে কনজুমার্স ঋণের সুদের হার বেশি। যদি সত্য হয়, তাহলে কেন?

মোখলেসুর রহমান :  প্রায়ই অভিযোগ ওঠে, কনজুমার্স ঋণ নিলে বেশি সুদ দিতে হয়। হ্যাঁ, অন্য ঋণের চেয়ে কনজুমার্স ঋণে বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয়। এর অন্যতম কারণ হলো, কনজুমার্স ঋণ নিতে গেলে গ্রাহকের কোনো জামানত দিতে হয় না। কোনো মেয়াদি ঋণ নিতে গেলে জামানত দিতে হয়। ওই ঋণগ্রহীতার কোনো ক্ষতি হলো বা দুর্ঘটনা হলে ব্যাংক বন্ধকি সম্পদ বিক্রি করে তার অর্থ আদায় করতে পারে। কিন্তু কনজুমার্স ঋণের কোনো জামানত দিতে হয় না। এ কারণে এ ঋণের ঝুঁকি বেশি।

নয়া দিগন্ত : কনজুমার্স ব্যাংকিং দেশের অর্থনীতিতে কিভাবে অবদান রাখছে?

মোখলেসুর রহমান : আমি মনে করি, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করার হাতিয়ার হলো এসএমই ঋণ। আর এ এসএমইকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করে কনজুমার্স ব্যাংকিং। দেশের উন্নত দেশগুলোর গোড়ার খবর নিলে দেখা যাবে, উন্নত অর্থনীতির শিখরে পৌঁছানোর জন্য অন্যতম প্রধান অবদান ছিল ুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত। যে দেশের এসএমই প্রসার যত বেশি হয়েছে, ওই দেশের উন্নতি তত টেকসই হয়েছে। আর এ এসএমইকে সহায়তা করেছে কনজুমার্স অর্থায়ন।

নয়া দিগন্ত : কনজুমার্স ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তির কিভাবে প্রসার ঘটেছে?

মোখলেসুর রহমান : কনজুমার্স ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার ঘটেছে। আজকের চেকবিহীন ব্যাংক লেনদেন হচ্ছে এটিএম কার্ডের মাধ্যমে। একজন গ্রাহক দিনে রাতে যেকোনো সময় তার প্রয়োজন মেটাতে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারছেন এই কার্ডের মাধ্যমে। পকেটে টাকা না নিয়েও বিপণি বিতান থেকে পছন্দের পণ্য কিনতে পারছেন ডেভিড কার্ডের মাধ্যমে। আর লেটেস্ট সংযোজন হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং। দেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে টাকা নিমিষেই গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। আরো রয়েছে ভিসা কার্ড, স্টুডেন্ট ব্যাংকিং, ভিসা করপোরেট কার্ড ইত্যাদি। আর এসব কিছুই এসেছে কনজুমার্স ব্যাংকিংয়ের খাতিরে।

নয়া দিগন্ত : কনজুমার্স ব্যাংকিংয়ের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী?

মোখলেসুর রহমান : নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝেও দেশের ব্যাংকিং খাতে কনজুমার্স ব্যাংকিংয়ের প্রসার লাভ করছে। যেহেতু কনজুমার্স ঋণ দিতে জামানত দিতে হয় না, তবে ঋণের বিপরীতে চাকরিজীবীর কর্মস্থলের বেতনের সার্টিফিকেট দিতে হয়। আর এখানেই সবচেযে বেশি প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয় গ্রাহক ও ব্যাংকারদের। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে বেতনের সার্টিফিকেট পেতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় গ্রাহকের। আর এ সার্টিফিকেটের কারণে কনজুমার্স ব্যাংকিংয়ের সেবা পান না অনেক গ্রাহক। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ সুযোগ একেবারেই নিতে পারেন না। কেননা, সরকারি অফিস থেকে বেতনের সার্টিফিকেট দেয়া হয় না। বেতনের সার্টিফিকেট পেতে হলে এজি অফিসে ধরনা দিতে হয়। আর এ কারণেই তারা কনজুমার্স ব্যাংকিংয়ের সেবা থেকে বঞ্চিত হন। দ্বিতীয়ত, কনজুমার্স অর্থায়ন অর্থাৎ ভোক্তাঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয় ৫ শতাংশ। অথচ এসএমই ঋণের বিপরীতে আগে প্রভিশন রাখতে হতো ১ শতাংশ। মাস তিনেক আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তা আরো রিলাক্স করা হয়েছে। এখন এসএমই ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। কিন্তু কনজুমার্স ফাইন্যান্সিংয়ে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে ৫ শতাংশ। আর এ কারণে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। শুধু প্রভিশনিং বেশি রাখতে হবে, এ কারণে অনেক ব্যাংকই কনজুমার্স ফাইন্যান্সিং বেশি করে না। তৃতীয়ত, কর্তৃপক্ষ কনজুমার্স ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কারণ, কনজুমার্স ঋণের ঝুঁকি বেশি। আর এর সাথে প্রভিশনিং করতে হয় অন্য ঋণের চেয়ে বেশি। এসব কারণে কনজুমার্স ব্যাংকিং কাক্সিতভাবে প্রসার লাভ ঘটছে না।

নয়া দিগন্ত : সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মোখলেসুর রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.