প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন by সরদার সিরাজুল ইসলাম

(খ) বাংলা ভাষাকে হত্যা করার একটি চক্রান্ত হিসেবে বাংলার আরবি অক্ষর প্রচলনের জন্য সরকারের নিন্দা। (গ) বাংলাকে সংখ্যাগুরু জনসাধারণের ভাষা হিসেবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ চাইলে উর্দুকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা।
(ঘ) অনতিবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য রাজবন্দীদের মুক্তি ও জন নিরাপত্তা আইন বাতিল দাবি করা হয়।
খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি ২ ফেব্রুয়ারি ’৫২ একটি লিখিত ইশতেহার প্রকাশ করে। ৪ ফেব্রুয়ারি ’৫২ পূর্ববঙ্গের সর্বত্র ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনুষ্ঠিত সভায় এম আর আখতার মুকুলের প্রস্তাবক্রমে গাজীউর হক সভাপতিত্ব করেন এবং বক্তব্য রাখেন আব্দুল মতিন ও কাজী গোলাম মাহবুব। সভাশেষে বেরোয় বিক্ষোভ মিছিল। বিকেলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভায় মওলানা ভাসানী, আব্দুল হামিদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। ঢাকা ছাড়া বরিশাল ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনাসহ দেশের সর্বত্র ধর্মঘট, সভা ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
৬ ফেব্রুয়ারি ১৪০ মোগলটুলী, ঢাকায় মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অর্থসংগ্রহের জন্য ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পতাকা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যুবলীগের ৮ ফেব্রুয়ারি সভায় এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানানো হয়। ছাত্ররা ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখা পতাকা বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট পালনের জন্য প্রচার চালায়। এই সময় নাদিরা বেগম ও শফিয়া খাতুন পোস্টার লেখার দায়িত্ব পালন করেন।
করাচী থেকে প্রকাশিত সরকার সমর্থিত ডন পত্রিকা ৫ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ভাষা প্রশ্নে পূর্ববঙ্গে আন্দোলনকে প্রাদেশিকতা বলে তীব্র নিন্দা করা হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার ১২ ফেব্রুয়ারি ছদ্ম ফ্যাসিজম শিরোনামে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে খাজা নাজিমুদ্দিনকে খলিফা ওসমানের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়, “ইসলামের তৃতীয় খলিফা খুবই ধার্মিক ও ভাল মানুষ ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন আত্মীয় প্রীতির দোষে দুষ্ট। তিনি নিজের এমন সব আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের লম্বা দাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলেন যার কোন ধরনের বিবেচনার যোগ্যই ছিল না। খাজা নাজিমুদ্দিন একজন ধার্মিক মানুষ এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না। আমরা আশা করি যে, তিনি নিজেকে একজন দ্বিতীয় ওসমান বিন আফফান প্রমাণ করবেন না’। দৈনিক অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকীয় নিন্দা করে মওলানা আকরম খান, রাগীব আহসান, মাওলানা গফুর, মাওলানা সামসুল হক, হাফিজ সোলায়মান প্রমুখ বিবৃতি প্রদান করে বলেন, সরকার যদি এ ব্যাপারে কিছু না করে তবে মুসলমানরাই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তারা ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সভা আহ্বান করে। ১৪ ফেব্রুয়ারি শাহ আজিজ ও সাহেবে আলম মর্নিং নিউজসহ অন্যান্য পত্রিকায় অবজারভার পত্রিকার নিন্দা করে বিবৃতি দেয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে পূর্ববাংলা সরকার “দুই বছর যাবত পত্রিকাটি খোলাখুলি অন্তঘাত চালিয়ে যাচ্ছে এবং পত্রিকা প্রকাশনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ এবং দেশ বর্হিভূত আনুগত্যের ... অজুহাতে নিরাপত্তা আইনে অবজারভার পত্রিকার মালিক হামিদুর হক চৌধুরী ও সম্পাদক আব্দুস সালাম খানকে গ্রেফতার করে (পরে জামিন প্রাপ্ত) এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ ও আল হেলাল প্রেসটিও বন্ধ করে দেয়া হয়। ছদ্ম ফ্যাসিজম নামে যে সম্পাদকীয়টি প্রকাশের জন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয় তার জন্য পরবর্তীতে তা প্রত্যাহার ও দুঃখ প্রকাশ করে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার পরিচালকম-লী ও সম্পাদকীয় বোর্ড বিবৃতি দেয়। বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার বিরুদ্ধে যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ দেশের বিভিন্ন সংগঠন বিবৃতি দেয় ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, পাকিস্তান অবজারভার ছিল সরকারবিরোধী মতামত প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ১৪ ফেব্রুয়ারি এক সরকারী ঘোষণায় ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ মার্চ স্থায়ী প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন আহ্বান করা হয়।
১৮ ফেব্রুয়ারি সরকার সমর্থিত নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একসভায় সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপের জন্য সভাপতি শামসুল হুদা ও মন্জুরুল হককে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে আক্তারউদ্দিন আহম্মদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচিত করে। ২১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট উপলক্ষে একদিকে ছাত্রসমাজ ব্যাপক প্রচার চালায় অপরদিকে পরিস্থিতির মোকাবেলা পূর্ব বাংলা সরকারের চিপ সেক্রেটারি আজিজ আহম্মদ বিশেষভাবে তৎপর হন। প্রয়োজনে যে কোন কাজ করিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে প্রবীণ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হায়দারকে বদলি করে তরুণ এস, এইচ কোরেশীকে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয় এবং তা ১৭ ফেব্রুয়ারি কার্যকরী হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট মিছিল এবং সম্ভাব্য প্রাদেশিক পরিষদ ছাড়াও এবং সংসদে প্রবেশের চেষ্টা থেকে ছাত্র জনতাকে বিরত রাখার উদ্যোগে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ দিনের জন্য সমগ্র ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা শোভাযাত্রা বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৪৪ ধারা জারি প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন বলেছিলেন যে তার সঙ্গে আলাপ না করেই চিপ সেক্রেটারি আজিজ আহম্মদ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সে সময় পূর্ববাংলা সরকার আজিজ আহম্মদের নির্দেশেই পরিচালিত হতো আর গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত আজিজ আহম্মদই নিতেন প্রয়োজন বোধে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনকে পরে জানিয়ে দিতেন। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী অবাঙালী আজিজ আহম্মদ খাজা নাজিমুদ্দিন বা নুরুল আমীনকে মনে করত অপদার্থ মেরুদ-হীন। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন শুরু হয় এবং খয়রাত হোসেন পাকিস্তান অবজারভারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির সংক্রান্ত একটি মলতবি প্রস্তাব উত্তোলন করেন যা মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের বিরোধিতার মুখে বাতিল হয়ে যায়। ২০ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা বিভিন্ন স্কুল কলেজে ২১শে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচী পালনের জন্য প্রচার চালায়। এই তৎপরতায় ছাত্রীদের মধ্যে শাফিয়া খাতুন ও শামসুল নাহার বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৪৪ ধারা জারির পরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং সন্ধ্যায় এসএম হলে ফকির শাহাবুদ্দিন আহম্মদ এবং ফজলুল হক হলে আবদুল মমিনের সভাপতিত্বে দুটি পৃথক সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুবের অনুরোধে বদরুদ্দিন উমর লিখিত আমাদের ভাষার লড়াই এবং যুবলীগের উদ্যোগে আনিুসজ্জামান লিখিত ‘রাষ্ট্রভাষা কি ও কেন? নামে দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। ১৪৪ ধারা জারি করার পরে একুশের কর্মসূচী কিভাবে পালিত হবে তা পর্যালোচনার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ৯৪ নওয়াবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগ কার্যালয়ে আবুল হাসিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন খয়রাত হোসেন এমএলএ, আনোয়ারা খাতুন এমএলএ, শামসুল হক (সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী মুসলিম লীগ), মীর্জা গোলাম হাফিজ, মুজিবুল হক (সহ-সভাপতি এমএম হল) হেদায়েত হোসেন চৌধুরী (সম্পাদক এম এম হল), শামসুল আলম (সহ-সভাপতি ফজলুল হক হল) আবদুল মতিন (ঢাবি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ) সৈয়দ আবদুর রহিম (সভাপতি রিকশা ইউনিয়ন), তমুদ্দিন মজলিশের আবুল কাসেম ও আবদুল গফুর, শওকত আলী (পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবির), গোলাম মাওলা (সহ-সভাপতি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ), ইসলাম ভ্রাতৃ সংঘের ইসতিয়াক আহম্মদ ও ইব্রাহিম তাহা, নুরুল আলম (ছাত্রলীগ), আখতার উদ্দিন (সরকার সমর্থিক নিখিল পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্রলীগ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি)। (ক্রমশ.)

No comments

Powered by Blogger.