মনরো ডকট্রিন by এবনে গোলাম সামাদ

১৮২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো ঘোষণা করেন, কোনো ইউরোপীয় রাষ্ট্র যদি পশ্চিম গোলার্ধের কোনো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়,
যা তাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী; তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই ষড়যন্ত্রে বাধা দেবে। এই হলো মনরো ডকট্রিনের মূল কথা। জেমস মনরো যখন তার এ বিখ্যাত ঘোষণাটি দেন, তখন আলাস্কা ছিল রাশিয়ার অধীনে। রাশিয়ার সম্রাট প্রথম জার আলেক্সান্ডার আলাস্কাকে কেন্দ্র করে চাচ্ছিলেন পশ্চিম গোলার্ধে প্রভাব বিস্তার করতে। এ জন্য তিনি সমর্থন করেছিলেন সেই সময়ের স্পেনের সম্রাটকে। স্পেনের সম্রাট চাচ্ছিলেন মেক্সিকো থাকুক তার প্রভাববলয়ে। তখন মেক্সিকোর নিয়ন্ত্রণে ছিল বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চল। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে সন্দিহান হয়ে উঠেছিল রাশিয়ার কার্যকলাপের ওপর। প্রেসিডেন্ট মনরো ঘোষণা করেছিলেন তার বিখ্যাত নীতি; যা খ্যাত হয়ে আছে মনরো ডকট্রিন (Monroe Doctrine) হিসেবে। এর অনেক দিন পর ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার বলেন, রাশিয়া যদি ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোয় কমিউনিজম  ছড়াতে চায়, তবে তিনি মনরো ডকট্রিন অনুসারে সেই প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করবেন। এ হলো মনরো ডকট্রিনের আইজেন হাওয়ার প্রদত্ত নতুন ব্যাখ্যা।

মনরো ডকট্রিনের কথা মনে আসছে একটা বিশেষ কারণে। রাশিয়ার সাথে আমেরিকার ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়েছে সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে। যখন কমিউনিজমের  অস্তিত্ব ছিল না। বর্তমানে কমিউনিস্টরা রাশিয়ায় ক্ষমতায় নেই। কিন্তু তথাপি রাশিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর পুরনো ক্ষমতার  লড়াই শেষ হয়েছে বলা যায় না। এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে চলেছে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য প্রতিযোগিতা। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন মস্কো সফরে। তিনি সেখানে, শোনা যাচ্ছে রাশিয়ার সাথে করেছেন এক গোপন চুক্তি; যাতে রাশিয়ান সাবমেরিন থাকতে পারবে চট্টগ্রাম বন্দরে। তিনি অবশ্য বলেছেন, রাশিয়ার কাছ থেকে তিনি সাবমেরিন কিনছেন। সেই ক্রীত সাবমেরিন থাকবে চট্টগ্রাম বন্দরে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটিকে ঠিক সেভাবে দেখছে না। তারা মনে করছে, রাশিয়া চট্টগ্রাম বন্দরে করতে যাচ্ছে সাবমেরিন ঘাঁটি। তার এ সন্দেহ করার কারণ আছে। কেননা ১৯৭১ সালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নকে কথা দিয়েছিলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে গড়তে দেয়া হবে সোভিয়েত সাবমেরিন ঘাঁটি। এ সময় ভারত তার অন্ধ্রপ্রদেশের বিখ্যাত বিশাখাপত্তম বন্দরে সোভিয়েত ইউনিয়নকে গড়তে দিয়েছিল অস্থায়ী সাবমেরিন ঘাঁটি। তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন চাচ্ছিল বাংলাদেশে একটি স্থায়ী সাবমেরিন ঘাঁটি গড়তে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এতে সম্মত ছিল। এখন আবার শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার কাছ থেকে সাবমেরিন কিনছে। আর সেই সাবমেরিন থাকবে চট্টগ্রাম বন্দরে অথবা বন্দরের কাছে; যা উদ্বিগ্ন করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। মনরো ডকট্রিন এশিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর সম্প্রসারণ ঘটাতে চাইতে পারে।

সম্প্রতি (৩০ জানুয়ারি ২০১৩)  বাংলাদেশের বিরোধী নেতা বেগম খালেদা জিয়া বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তাতে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য ও সহযোগিতা করা। তিনি এ প্রবন্ধটি লিখেছেন শেখ হাসিনার মস্কো সফরের পর। তিনি এ প্রবন্ধে বলেছেনÑ  ÔIt is time for the world, led by America, to act and ensure that democracy is saved in Bangladesh.’’ খালেদা জিয়ার এ প্রবন্ধটি লেখার জন্য বাংলাদেশের বাম বুদ্ধিজীবীরা তাকে সমালোচনা করতে শুরু করেছেন ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের’ প্রতিভূ হিসেবে। কিন্তু খালেদা জিয়া প্রবন্ধটি লিখেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফরের পর। তার আগে নয়। মস্কো সফরে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের করেছেন লাগামছাড়া প্রশংসা। তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে অতি একান্তে করেছেন দীর্ঘ সময় ধরে শলাপরামর্শ; যা থেকে অনেকের ধারণা হচ্ছে তিান রুশ প্রেসিডেন্টের সহায়তায় বাংলাদেশে পেতে চাচ্ছেন ক্ষমতায় থাকার স্থায়িত্ব। যেহেতু রাশিয়া আসছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে, তাই তাকে বাধা দেয়ার জন্য খালেদা জিয়া চেয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতা। না হলে তিনি এ রকম প্রবন্ধ লিখতেন বলে মনে হয় না। যদি তিনি লিখতেন, তবে সাধারণভাবেই করা যেতে পারত তার বিশেষ সমালোচনা। আর আমরাও তার সমালোচনায় নিশ্চয় নিতাম অংশ। কারণ আমরা চাই না বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে বৃহৎ শক্তির ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে টেনে আনতে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, রাশিয়া টাকার অভাবে আলাস্কা ১৮৬৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দেয় ৭,২০০,০০০ মার্কিন ডলারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আলাস্কার আছে বিরাট বনজসম্পদ। আছে সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য বন্দর গড়ার সুযোগ-সুবিধা। যে রকম বন্দর গড়ে তুলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা কেনার পর সেখানে আবিষ্কৃত হয়েছে স্বর্ণ, রুপা, তেল, লোহা, কয়লা, টিন ও তামার খনি। আলাস্কা হলো একটি বিরাট দেশ। এর ভৌগোলিক আয়তন হলো ৫৮৬৪০০ বর্গকিলোমিটার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আলাস্কা ক্রয় করে হতে পেরেছে বিভিন্ন দিক থেকেই  যথেষ্ট লাভবান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আলাস্কা একটি উপনিবেশ হয়ে থাকেনি। ১৯৫৯ সালের ৪ জুলাই তা পরিণত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখন কোনো বৈদেশিক উপনিবেশ নেই। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাষ্ট্র। সেখানে জন্মেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জকে নিজের অধীনে না রেখে দিয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা (৪ জুলাই ১৯৪৬)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী দেশ আর রাশিয়া তা নয়Ñ এমন যুক্তি ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে উত্থাপন করা চলে না। রাশিয়ার এক সময় ছিল বিরাট সাম্রাজ্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ১৫টি রিপাবলিকে গঠিত। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এভাবে ভেঙে পড়েনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৩টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে। কিন্তু এখন তার অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা হলো ৫০। আর এরা কেউই চাচ্ছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিযুক্ত হতে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে সমালোচনা করে লাভ নেই। যে রকম লাভ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালে ভেঙে পড়ার আগে। ১৯৯১ সালের আগে রাশিয়া আদর্শগতভাবেই অনেকের কাছে ছিল আদরণীয়। কিন্তু কমিউনিস্টরা আর এখন রাশিয়ায় ক্ষমতায় নেই। আগের আদর্শের আবেদন এখন আর কার্যকরী নয়। এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের কাছে ছিল বিশেষ অর্থেই একটা অপরিচিত দেশ। কিন্তু এখন তা নয়। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ সেখানে গিয়ে পরে গ্রহণ করছে মার্কিন নাগরিকত্ব। বাংলাদেশের বহু পরিবারের নিকটাত্মীয়রা এখন মার্কিন নাগরিক। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের মানুষ আর চিন্তা করছে না অতটা বিদেশ হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডে এখন অনেক বাংলাদেশী গিয়ে উপনিবিষ্ট হয়েছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস এসব অঞ্চলের মানুষকে যাচ্ছে প্রভাবিত করে। খালেদা জিয়াকে তাই ‘সাম্রাজ্যবাদের দালাল’ বলে সমালোচনা করে, যাচ্ছে না আগের মতো আলোড়ন সৃষ্টি করা।

অনেক কিছুই ঘটছে আমাদের দেশে। বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গড়েছে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু এখন এই ট্রাইব্যুনালের রায় যেহেতু তাদের মনমতো হচ্ছে না, তাই তারা নিজেদের গঠিত ট্রাইব্যুনালের করছে বিশেষ সমালোচনা; যা  আইনের শাসনের পুরোপুরি পরিপন্থী। এরও একটা প্রভাব পড়তে যাচ্ছে সারা বিশ্বের জনমতের ওপর। খালেদা জিয়াকে সমালোচনা করে খুব একটা লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা হয়ে পড়েছে ক্ষীণ। বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাকস্বাধীনতার মধ্যে পড়ে মুক্তভাবে লিখে মত প্রকাশের অধিকার। নিউ ইয়র্ক টাইমস হয়ে উঠেছে একটা আন্তর্জাতিক পত্রিকা। সেটি কেবলই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা আর নয়। খালেদা জিয়া মার্কিন এ পত্রিকায় লিখে বাকস্বাধীনতার খেলাপ করেননি। অন্তত আমাদের মতো অনেকের কাছেই মনে হচ্ছে তাই।

লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.