একুশে গ্রন্থমেলার বাণিজ্যিক রূপ by শফিকুল ইসলাম

বাংলা একাডেমীর অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাণিজ্যিক মেলায় পরিণত হয়েছে। একাডেমী প্রাঙ্গণের বাইরে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের পসরা সাজিয়ে গ্রন্থমেলাকে বাণিজ্যমেলার রূপ দিয়েছেন হকারেরা।
জুতা-স্যান্ডেল, ছোটদের খেলনাসামগ্রী, মুুড়ি-মুড়কি পাইরেটড বইÑ কী নেই যা পাওয়া যাচ্ছে না বইমেলায়? কিন্তু মেলা শুরুর দশম দিনেও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীর। বইমেলায় আগত ক্রেতা-দর্শকদের অনেকেই বলছেন, মেলা থাকবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কিন্তু বইমেলার বাইরে আরেক মেলা বসেছে। এসবের প্রতি বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া উচিত। প্রবীণ লেখক ও কবি মহাদেব সাহা বলেন, গ্রন্থমেলা অতীতে সব সময়ই ভালোভাবে উপভোগ করেছি। কিন্তু আগের মতো এখন মেলায় প্রাণচাঞ্চল্য দেখছি না।

বইমেলার বাইরে অন্য মেলা : বাংলা একাডেমীর বাইরে আরেক মেলা বসেছে। তবে এ মেলা বারোয়ারি মেলা। যেখানে বিভিন্ন নিম্নমানের ও কম দামের পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। একাডেমীর বাইরে রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের নোটবই বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছেÑ মানিব্যাগ, ছোটদের খেলনাসামগ্রী, প্লাসটিকের পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য। মেলায় আগত ক্রেতা-দর্শক এসবের কারণে বইমেলায় প্রবেশ করতে ভোগান্তিতে পড়ছেন আগতরা। মেলায় আগত এক তরুণ মিলন জানালেন- বইমেলার বাইরে রাস্তায় বিভিন্ন দোকান দেখে মনে হচ্ছে এখানেই মেলার মূল আসর, আসলে তা নয়। তিনি বলেন, বাংলা একাডেমীর ভেতরে যে আসল বইমেলা তা বাইরের অবস্থা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই।

এ ছাড়া বইমেলার ভেতরে বাংলা একাডেমী কর্মচারী ইউনিয়নের যোগসাজশে বসানো হয়েছে আইসক্রিমের দোকান, যা বইয়ের স্টলে আসা ক্রেতা-দর্শকের জন্য সমস্যারও কারণ। শ্রাবণ প্রকাশনীর সামনে রাখা এ দোকানের কারণে প্রকাশক রবীন আহসান কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে একটু সরিয়ে পাশেই ফের বসানো হয়। এ নিয়ে প্রকাশক সমিতিও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, মেলার নীতিমালা অনুসরণ করা উচিত। তবে আইসক্রিমের দোকান থেকে শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো: জাকির হোসেন কোতোয়াল চাঁদা নেন বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফোন রিসিভ করেননি জাকির হোসেন।

বুর্জোয়া ভাব : বাংলা একাডেমীর অমর একুশে গ্রন্থমেলা আগের মতো নেই বলে জানালেন কবি মহাদেব সাহা। গতকাল বইমেলায় কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, আমার কাছে বইমেলা সব সময়ই ভালো লাগে। তবে আগের চেয়ে বইমেলা এখন নানা রূপ ধারণ করেছে। বইমেলা এখন অভিজাত আর বুর্জোয়াদের কবলে। তিনি বলেন, মেলায় বুর্জোয়া গন্ধ ও মার্কিন ঘেঁষা উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এ দিকে বইমেলাকে প্রতিবাদ জানানো আর সংস্কৃতির স্থান বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, বইমেলায় ভালো মানের বই প্রকাশ করতে এবং বই কিনতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া উচিত। শুধু মেলাকে ঘিরে বই প্রকাশ করা হলে ভালো মানের বই পাওয়া যাবে না। প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সারা বছরই বই প্রকাশ করা দরকার।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : অমর একুশে গ্রন্থমেলার সদস্যসচিব শাহিদা খাতুন মেলা সম্পর্কে বলেন, আমাদের মেলার যতটুকু এরিয়া এর মধ্যে কিন্তু কোনো হকারের দোকান নেই। তবে রাস্তায় যেসব হকার পসরা সাজিয়েছেন আমরা তার ব্যবস্থা নেবো। এ জন্য একটি উপকমিটিও গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি কাজ করছে। আমরা সার্বক্ষণিক মেলার অসঙ্গতি দূর করতে কাজ করছি।

গতকালের নতুন বই : বইমেলার দশম দিনে গতকাল ১১৩টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। নতুন বইয়ের মধ্যে গল্প ২০টি, উপন্যাস ১৯টি, প্রবন্ধ চারটি, কবিতা ৩২টি, গবেষণা একটি, ছড়া তিনটি, জীবনী চারটি, মুক্তিযুদ্ধ একটি, বিজ্ঞান দু’টি, ভ্রমণ চারটি, চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য দুই, রম্য বা ধাঁধা তিনটি, সায়েন্স ফিকশন তিন এবং অন্যান্য ১৫টি। নতুন বইয়ের মধ্যে ঐতিহ্য প্রকাশনী এনেছে বুলবুল সরওয়ার রচিত ভ্রমণবিষয়ক বই নীল যমুনার জল, খন্দকার ইশতিয়াক মাহমুদ অনূদিত গ্রন্থ আমেরিকান সায়েন্স ফিকশন গল্প-২, ডা: মো: শহীদুল্লাহর স্বাস্থ্যবিষয়ক বই কোলেস্টেরল ও রোগবালাই, সূচীপত্র থেকে শাকিলা হোসেনের গল্পগ্রন্থ সিঁড়িতে কয়েকটি ফুল ও মতিউর রহমান চৌধুরীর কূটনীতির অন্দরমহল, অনন্যা থেকে এ কে এম মহসীন রচিত আধুনিক ফটো সাংবাদিকতার কলাকৌশল ও ডা: সজল আশফাকের ওষুধ পথ্যি ও ডাক্তার বদ্যি এবং আবেদ খানের জীবনের গল্প জীবনযুদ্ধের গল্প, অনুপম থেকে নিকোলাই গোপনের গল্প ওভারকোট, আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে মো: মোতাহার হোসাইন রচিত ভ্রমণকাহিনী স্বপ্নের দেশ সুইজারল্যান্ড এবং শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে আনিস রহমানের ভাবনায় নগরায়ন প্রতিবেশ ইত্যাদি। তবে মেলার দশম দিনে নতুন ১০টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে।

মেলামঞ্চে গতকাল : প্রতিদিনের মতো গতকাল গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : অনন্য লেখকের প্রতিকৃতি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রবন্ধ পাঠ করেন প্রাবন্ধিক-গবেষক অধ্যাপক মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশ নেন অনুবাদক অধ্যাপক আবদুস সেলিম এবং কথাশিল্পী আহমাদ মোস্তফা কামাল। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি গবেষক, কথাশিল্পী ড. ফজলুল আলম। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী নাদিরা বেগম, পাগলা বাবুল, ফকির শাহাবুদ্দিন, মো: নূরুল ইসলাম, আলম দেওয়ান, আজগর আলীম, আনিমা মুক্তি গোমেজ, আমজাদ দেওয়ান, সাইদুর রহমান বয়াতি ও টুকু বাউল।

মেলামঞ্চে আজকের অনুষ্ঠান : আজ বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে ‘তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সাংবাদিক আবেদ খান। আলোচনায় অংশ নেবেন রাহাত খান, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও মোহাম্মদ সেলিম। সভাপতিত্ব করবেন হারুন অর রশিদ। সন্ধ্যায় থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

No comments

Powered by Blogger.