শরণার্থী শিবির থেকে ক্রিকেট-তারা by আরিফুল ইসলাম

গম্ভীর মুখে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ব্র্যাড হজ। পাশেই বসে ইন্টারনেটে কী সব ঘাঁটাঘাঁটি করছেন ডার্ক ন্যানেস। লিফট থেকে বেরিয়ে ইতিউতি তাকাচ্ছেন শিবনারায়ণ চন্দরপল।
তখনই আবার অনুশীলন থেকে ফিরলেন খুলনা রয়েল বেঙ্গলসের ক্রিকেটাররা। চট্টগ্রামের হোটেল আগ্রাবাদের বিজনেস সেন্টার হঠাৎই যেন এক টুকরা ক্রিকেট বিশ্ব। ঠিক ওই মুহূর্তেই সিঁড়ি দিয়ে নামলেন একজন। সব মনোযোগও কেড়ে নিলেন। হাই-হ্যালো, সালাম—সবার দৃষ্টি যেন মোহাম্মদ নবীর দিকে!
‘আপনিই তো দেখা যাচ্ছে তারকাদের তারকা!’...শুনে যেন খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেলেন নবী। আসলে যে তিনি তারকা-টারকা নন, সেটা বোঝাতেও তৎপর হয়ে উঠলেন, ‘আফগান ক্রিকেটার বলেই সবার এত আগ্রহ, মনোযোগ...। এমসিসির হয়ে খেললাম একবার ব্রায়ান লারা, চামিন্ডা ভাস, ক্রিস হ্যারিসদের সঙ্গে। গাঙ্গুলী (সৌরভ) ছিল অধিনায়ক। তখনো ওদের সবার আগ্রহ দেখি আমার দিকে। অনেকে জানতও না, আফগানিস্তানে ক্রিকেট খেলা হয়, আফগান ক্রিকেট এত এগিয়েছে।’
এগিয়েছে তো বটেই, আর সেই এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম নায়ক নবী নিজে। ক্রিকেটাকাশের হাজারো তারায় তাঁকে আলাদা করে চেনা মুশকিল হতে পারে, কিন্তু আফগান ক্রিকেটে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারার নাম নবী। অনেক আফগান কিশোর-তরুণের ঘরের দেয়ালে তাঁর পোস্টার, সিলেট রয়্যালসের খেলা দেখালে কাবুল-জালালাবাদে টিভির পর্দায় চোখ থাকে লাখো আফগানের। এমসিসির হয়ে খেলেছেন বেশ কবার। পেছন ফিরে তাকালে বর্তমানকে নবীর মনে হতে পারে স্বপ্নের ঘোরে হাঁটাহাঁটি!
জন্ম ও বেড়ে ওঠা তাঁর পেশোয়ারের আফগান সীমান্তে। সামরিক অভ্যুত্থান আর গৃহযুদ্ধের ডামাডোলে ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তান ছেড়ে পেশোয়ারে পাড়ি জমিয়েছিল নবীর পরিবার। শুরু বিদেশ-বিভুঁইয়ে কপর্দকহীন অবস্থায় জীবনযুদ্ধ। ১৯৮৫ সালে জন্ম নবীর, শৈশব কেটেছে দারিদ্র্যে। তবে বাবা-চাচারা যখন কাপড়ের ব্যবসায় নেমে পরিশ্রম করছেন দিন-রাত, কিশোর নবীর মাথায় তখন ক্রিকেটের ভূত। চাচাতো ভাইদের সঙ্গে মিলে একটা পারিবারিক ক্রিকেট দলও গড়ে ফেললেন। বয়স ১৫-১৬ হতেই খেলা শুরু করলেন স্থানীয় এক ক্লাবে।
জীবনযুদ্ধে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত, ক্রিকেট-বিলাসিতা মোটেও মেনে নিতে পারেননি বাবা-মা, ‘সবাই বলত পারিবারিক ব্যবসায় মন দিতে, খেলাটা পেশা হতে পারে বুঝত না। বলত, কোনো ভবিষ্যৎ নেই ক্রিকেটে। তবু আমি বন্ধুর সঙ্গে লুকিয়ে ক্লাবে যেতাম খেলতে।’ একদিন পত্রিকায় দেখলেন, আফগানিস্তান ক্রিকেট দল আসছে পাকিস্তানে প্রীতি ম্যাচ খেলতে। ‘আফগানিস্তানেও ক্রিকেট দল আছে’ জেনে মনে মনে ভবিষ্যতের ছবিটাও এঁকে ফেললেন। কদিন পর এক বন্ধুর কাছে শুনলেন, অনূর্ধ্ব-১৭ ক্রিকেট ট্রায়াল হবে আফগানিস্তানে। বাবা-মাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে নবী ছুটলেন স্বদেশে, জীবনে প্রথমবার!
সেটি ২০০৩ সাল, যুদ্ধবিধ্বস্ত মাতৃভূমিকে দেখে কেঁদেছিল তাঁর হূদয়, ‘কিছুই ছিল না আফগানিস্তানে...চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, মনে হয় না দু-একটা বাড়ি ছাড়া খাড়া কোনো দেয়াল আমি দেখেছি। রাস্তাঘাট সব ভাঙাচোরা, লাশের পর লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি রাস্তার পাশে।’ ভয়-শঙ্কা মনে চেপে বসেছিল, কিন্তু ট্রায়ালে টিকে যাওয়ার পর আর পেছন ফিরে তাকাননি। অধিনায়ক হয়ে এসিসি অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্টে খেলতে গেলেন ভারতে, ফিরেই জাতীয় দলে ডাক। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। আইসিসি ওয়ার্ল্ড ডিভিশন ফাইভ থেকে তরতর করে উঠে এল আফগানিস্তান, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলল, পেল ওয়ানডে স্ট্যাটাস। আক্রমণাত্মক ব্যাটিং আর নিয়ন্ত্রিত অফ স্পিন দিয়ে এই এগিয়ে যাওয়ার পথে অগ্রণী সৈনিক নবী।
আফগানিস্তান ও নবীর এগিয়ে যাওয়ার আরেকটি প্রমাণ যেন এবারের বিপিএল। সিলেট রয়্যালসে নবী, খুলনায় শাপুর জাদরান ও সামিউল্লাহ শেনওয়ারি। নবী যোগ করেন, ‘আরও বিশ্বমানের ক্রিকেটার আছে আমাদের। দওলত জাদরান, হামিদ হাসান, গুলবদিন নাইব, মোহাম্মদ শাহজাদরা এই টুর্নামেন্টে অনায়াসেই খেলতে পারে।’ আফগানিস্তান জাতীয় দল এখন পাকিস্তানে, আগামী পরশু থেকে শহীদ আফ্রিদির পাকিস্তান ‘এ’ দলের বিপক্ষে সিরিজ। কিন্তু বিপিএলে খেলা ‘আফগান ক্রিকেটেরও গর্ব’ বলে তিনজনকে অনাপত্তিপত্র দিয়েছে বোর্ড।
২০০৬ সালে ভারতে এমসিসির বিপক্ষে এক ম্যাচে ৩৯ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন। মুগ্ধ এমসিসি কোচ মাইক গ্যাটিং পরে এমসিসির হয়েই খেলার সুযোগ করে দেন নবীকে। এমসিসির হয়ে লারা-দ্রাবিড়দের সঙ্গে খেলাকে মনে করেন জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। এবার বিপিএল খেলছেন, একদিন আইপিএল-বিগ ব্যাশেও খেলতে চান। স্বপ্নের সীমানা তাঁর আরও বড়, ‘স্বপ্ন দেখি আফগানিস্তানের হয়ে টেস্ট খেলার। ক্রিকেট বোর্ড যদি অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে পারে, তাহলে অবশ্যই সম্ভব। কারণ আমার কোনো সন্দেহই নেই যে মাঠের পারফরম্যান্স আমাদের ভালো থেকে আরও ভালো হবে।’
আফগান ক্রিকেটের স্বপ্নের ক্যারাভান যেভাবে ছুটছে, নবীর স্বপ্ন পূরণ হওয়াটাও হয়তো অসম্ভব নয়!

No comments

Powered by Blogger.