হরতালের নামে জ্বালাওপোড়াও মানুষ হত্যা বন্ধ করতে হবে by গোলাম আকবর চৌধুরী

আজকে দেশে যে সহিংসতা, অরাজকতা চলছে তা অভাবনীয়। যারা হরতালের নামে গাড়ি ভাঙচুর, আগুন দিয়ে গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, মানুষ হত্যা করে, সকল নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে আইন মানে না, সুপ্রীম কোর্টের রায় মানে না,
সংবিধান মানে না, তারা কি অধিকারের নামে, গণতন্ত্রের নামে যা কিছু করতে পারে? তাদের কারণে দেশের কোটি কোটি মানুষ ঘরে বদ্ধ হয়ে থাকে, দৈনন্দিন কাজে যোগ দিতে পারে না, সরকারী ও বেসরকারী অফিস বন্ধ থাকে এবং সাধারণ মানুষ কাজে যোগ দিতে পারে না বলে অনেক সময় তাদেরকে না খেয়ে থাকতে হয়। সারাদেশে অর্থনৈতিক কাজকর্ম বন্ধ থাকে, কলকারখানা বন্ধ থাকে। ফলে আমাদের আমদানি-রফতানি ব্যবসাও বন্ধ থাকে। সময়মত ংযরঢ়সবহঃ দিতে না পারলে বিদেশের সাথে তাদের চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং তাদের আর্থিক ক্ষতি হয়। এর ফলে দেশের অগ্রগতি বন্ধ হয়ে যায়। এর মাসুল দেবে কে? দেশের সকল শ্রেণীর ও সকল পেশার মানুষ? এই ধ্বংসাত্মক কাজে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। দেশ মুখোমুখি হবে কঠিন সঙ্কটের। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? তারা কি একবারও ভেবে দেখে এই হরতালের ফলে দেশ ও জনগণের শুধু ক্ষতিই হবে? হরতালকারীরাও লাভবান হবে না। তাহলে ক্ষণিকের উন্মাদনায় এই গণবিরোধী হরতাল করে লাভ কি? সমস্যার সমাধান হবে কিভাবে? দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে, সুশীল সমাজকে ও জনগণকে ভেবে দেখতে হবেÑকিভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। মনে রাখতে হবে সীমা লঙ্ঘন করলে একদিন ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণ রুখে দাঁড়াবে। এখানে আমি একটা ছোট উদাহরণ দিতে চাই। ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরে ড. কামাল হোসেন টেলিফোনে আমাকে জানালেন জেনারেল জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। দেশের অবস্থা থমথমে। এই অবস্থায় আমাদের কি করতে হবে। আমি উত্তরে বললাম আমি চারদিকে খবর নিচ্ছি; আপনি আমার সাথে যোগাযোগ রাখুন। তারপর একই খবর নিয়ে টেলিফোন করলেন প্রাক্তন আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল মালেক উকিল। তাকেও বললাম আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে। তারপর টেলিফোন করেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা আসাদুজ্জামান খান। তাঁকেও বললাম আমি সার্বিক পরিস্থিতির খবরাখবর নিচ্ছি, আমার সাথে যোগাযোগ রাখবেন। তারপর আমরা বসে এ বিষয়ে আলাপ আলোচনা করব। এখানে উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা সিলেটে গেছেন ২৯ মে প্রথম জনসভায় যোগ দিতে।
তারপর খবর পেলাম বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, আইভি রহমান ও মোহাম্মদ হানিফকে (পরে ঢাকার মেয়র) গ্রেফতার করা হয়েছে। আমার পাশের বাসায় থাকতেন বিএনপির প্রভাবশালী নেতা শামসুল হুদা চৌধুরী। তাঁকে গিয়ে বললাম, “আপনারা আমাদের নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেছেন কেন?” তিনি বললেন, “এ রকম কোন খবরতো আমি পাইনি।” তখন আমি তাঁকে বললাম, “দেখুন আমার বাসার সামনে অনেক কর্মী জমায়েত হয়েছে এবং আরও কর্মী আসতে থাকবে। আপনারা কিছু না করলে আমি বাধ্য হয়ে তাদেরকে নিয়ে আপনাদের বিরুদ্ধে মিছিল করব।” তখন তিনি বললেন, “একটু সময় দিন।” তখন তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে টেলিফোন করলেন এবং ঘটনাগুলো জানালেন। তখন সাত্তার সাহেব তাঁকে জানালেন গ্রেফতার করেছে সামরিক বাহিনী। আমি তখন বললাম, “আপনারা কিছু না করতে পারলে আমাদের পথে নামা ছাড়া কোন বিকল্প থাকবে না।” তখন সাত্তার সাহেব বললেন, “একটু সময় দিন, এসব করতেছে এরশাদ সাহেব।” তিনি আরও বললেন, “এরশাদ সাহেব ভারতীয় সৈন্যরা আসতে পারে বলে দেশে ক্ষমতা নিতে চাইছেন, এজন্যই তিনি নেতাদের গ্রেফতারের পরিকল্পনা করছেন।” তারপর আমাকে বললেন গ্রেফতারকৃতদের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি দেবে। তিনি আরও বললেন যে, দেশের বর্তমান শাসনতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে আমরা (অর্থাৎ আওয়ামী লীগ) যেন তাদেরকে সহায়তা করি।
আমি বললাম, “শুধু গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দিলে হবে না। আর কোন আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতার করা হবে না-এই মর্মে নিশ্চয়তা দিতে হবে।” তখনই উত্তর দিলেন, “আর কোন আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতার করা হবে না।” তারপর বললাম, “আমরা আলাপ-আলোচনা করে আপনাদের সহায়তা করার ব্যপারে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাব।” কিছু সময় পর খবর পেলাম বেগম তাজউদ্দীন, আইভি রহমান ও মোহাম্মদ হানিফকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর আমি ড. কামাল হোসেন, আবদুল মলেক উকিল ও আসাদুজ্জামানের সাথে কথা বলে তাঁদেরকে রাষ্ট্রপতির সাথে আলাপ আলোচনার ব্যাপারে জানালাম এবং পরদিন সকাল ১০টায় আসাদুজ্জামনের বাসায় বৈঠকে সরকারকে সহায়তা করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। সভা চলাকালে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী-আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার একটা চিঠি নিয়ে আমাদের দিলেন। চিঠির মূল বক্তব্য ছিল গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে আমরা সরকারকে সহায়তা দিতে পারি। দেখলাম আমাদের চিন্তা ও শেখ হাসিনার চিন্তা একই। তখন আমাদের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো আমরা বিএনপিকে শাসনতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সহায়তা দেব। তখন প্রশ্ন উঠল কে যাবেন রাষ্ট্রপতির কাছে। এ ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাতে সবাই আমাকে যেতে বললেন। আমি বললাম ড. কামাল হোসেন, আবদুল মালেক উকিল ও আসাদুজ্জামান খানের যে কোন একজন যেতে পারেন। তবে প্রটোকল অনুযায়ী আসাদুজ্জামান খানের যাওয়াটা যথাযথ হবে বলে মনে করি। তিনিই হলেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। এ কথা বলার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো কি করে আমার মতো একজন রাজনৈতিক কর্মী এতবড় একটা সঙ্কটের সমাধানের উদ্যোগ নিলাম। এখানে আরও উল্লেখ করতে চাই, আওয়ামী লীগের সমর্থনের কারণে বিএনপি সরকারের ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয়েছিল। তাই আমি বিশ্বাস করি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের উর্ধে উঠে এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাঁদের সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে একটা সমাধনে পৌঁছতে পারবে। তবে আলোচনার বিষয়ে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকা সমীচীন। সবাই যা খুশি বললে এর কার্যকারিতা পাওয়া যাবে না। আমার মনে হয় একটা সীমারেখার মধ্যে থেকে আলোচনা করলে সমাধানে পৌঁছা অসম্ভব হবে না। জাতির এ দুঃসময়ে সবাই এগিয়ে না এলে দেশ মহাসঙ্কট থেকে মুক্তি পাবে না।
লেখক : কলামিস্ট ও বীমা ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.