বীরাঙ্গনা ৭১ ॥ যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধু সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল by মুনতাসীর মামুন

এদের পুনর্বাসনের দুটি দিক ছিল এক, বিয়ে, দুই জীবিকা অর্জনের পথ। বিয়ে, আগেই উল্লেখ করেছি নির্যাতিতাদের যে একেবারে হয়নি তা নয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধা হয়তো তাদের প্রেমিকাকে বিয়ে করেছেন।
(ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী এর উদাহরণ) অনেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে নির্যাতিতাকে বিয়ে করেছেন। অনেকে ধর্ষিতা স্ত্রীকে গ্রহণ করেছেন। অনেকের বিয়ে হয়েছে ধর্ষণের কথা গোপন রেখে। পরবর্তীকালে দেখি, ধর্ষণের কথা জানাজানি হওয়ার পর তাদের লাঞ্ছনার সম্মুখীন হতে হয়েছে, স্বামী পরিত্যক্ত হয়েছেন, যার কয়েকটি উদাহরণ আগে উল্লেখ করেছি।”
সুসান ব্রাউনমিলার জানাচ্ছেন, পত্রিকার প্রতিবেদনে পড়েছেন তখন সরকারী কর্মচারীরা বলছিলেন, বিবাহ ইচ্ছুকদের দাবি বাড়ছে। সেই দাবি হলো, লাল টুকটুকে টয়োটা গাড়ি থেকে কবিতা প্রকাশ পর্যন্ত। অনেক নির্যাতিতা আবার পুরুষের উপস্থিতিও সহ্য করতে পারছেন না। সুসানের ভাষায়,
“The demands of the men have ranged from the latemodel of Japanese car, painted red, to the publication of unpolished poems; a government official bitterly complained Another stumbling block, perhaps unexpected by the Bangladeshis, was the attitude of the raped women,` Many won’t be able tolerate the presence of a man for sometime, The same official admitted.”
সীমিত সম্পদ নিয়েই বঙ্গবন্ধুর সরকার সমস্যা মোকাবেলায় এগিয়ে আসে। সুসান ব্রাউনমিলারও তাঁর গ্রন্থে এ জন্য নিয়োজিত নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের উদ্যোগ ও কার্যক্রমকে যবৎড়রপ সড়ারহম ভড়ৎপব হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বীরাঙ্গনাদের জন্য তৎকালীন মহিলা সংস্থাগুলো ছাড়া সরকারই এগিয়ে আসে। মহিলারা অনেকেই আর সংসারে ফিরতে চাচ্ছিলেন না আগে এ বিষয়ে উল্লেখ কেরছি। পূর্বোক্ত জাপানি রেডক্রস কর্মী হুকিউরার বয়ানটি এখন উদ্ধৃত করছি। তিনি কুমিল্লায় যে চারজনের দেখা পেয়েছিলেন তারা সবাই তাকে বলেছিলেন, এত অপমানকর ও লজ্জাজনক ভাগ্যের শিকার হয়ে স্বামী ও পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তারা চান ভারত বা দূরবর্তী অন্য কোনো দেশে গিয়ে বাকি জীবন কাটাতে।”
হুকিউরা ঢাকায় এসে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে বিষয়টি জানান, বিশেষ করে কারিতাসের কর্মকর্তাদের জানান। ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামানও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানান। সম্ভবত এর ফলে রেডক্রসের চেয়ে আর্থিক দিক দিয়ে ধনী সংস্থা কারিতাস মহিলাদের এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে।
জনপ্রতিনিধি বা সিভিল সমাজের সচেতন নাগরিকরা বীরাঙ্গনাদের নিয়ে সব সময়ই সচেতন ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য বদরুন্নেসা আহমদ যখন কলকাতায় ছিলেন তখন উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে নিয়মিত যেতেন, লাঞ্ছিতাদের সহায়তা দেবার চেষ্টা করতেন। অবরুদ্ধ ঢাকায়ও শুনেছি, কয়েকজন সমাজকর্মী ইস্কাটনে একটি কেন্দ্রের মতো করেছিলেনÑ সেখানে লাঞ্ছিতদের সীমিত আকারে চিকিৎসা, আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইস্ট পাকিস্তান গার্ল গাইডস এ্যাসোসিয়েশনের নেত্রীরাও খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করছিলেন।
গার্ল গাইডসের সম্পাদক ছিলেন মালেকা খান। ডিসেম্বর ২০-২১ তারিখের দিকে তিনি যান নাখালপাড়ায় এমপি হোস্টেলে, যেখানে সৈন্যরা বেশকিছু নারীকে বন্দী করে রেখেছিল। কয়েকবার ট্রিপ দিয়ে অর্ধনগ্ন সবাইকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন একটি সেফ হাউসে।
৪ জানুয়ারি সমাজের ১৯ জন ব্যক্তিত্ব যাদের মধ্যে ছিলেন কুদরাত-ই-খুদা, সৈয়দ মুর্তজা আলী, কবীর চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, আহমদ শরীফ প্রমুখ। এক বিবৃতিতে তারা সবাইকে, বিশেষ যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানান লাঞ্ছিতা বোনদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তারা বলেন, ‘যাদের অপমৃত্যু হয়েছে তারা আমাদের সমস্যা নন, যারা বেঁচে আছেন তাদের জীবন যেন ব্যর্থ না হয়, সে জন্য স্বাধীন দেশের শিক্ষা-প্রবুদ্ধ সংস্কৃতিবান ও উদারপ্রবণ তরুণ নাগরিকদের মনুষ্যত্বের কাছে এবং তাদের সংবেদনশীলতার কাছে আজ আমাদের এই আকুল আবেদন।
আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিক বদরুননেসা আহমেদও এক বিবৃতিতে বীরাঙ্গনাদের খোঁজখবর নেয়ার জন্য সবার প্রতি আবেদন জানান যাতে তাদের জন্য কিছু করা যায়। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বাংলার মা-বোনেরা যারা নির্যাতিত বা অভিভাবকহীন হয়েছেন তাঁদের পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তার জন্য সঠিক তথ্যের প্রয়োজন। আমি এই সূত্রে আবেদন করছি, যাঁরা পাক বাহিনীর বা আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর বর্বর হামলার শিকার হয়েছেন বা হতে দেখেছেন অথবা যাঁরা সঠিক খবর এবং বর্তমান পরিস্থিতি জানেন তারা নিজ নিজ স্থানের আওয়ামী লীগ মহিলা সম্পাদিকার কাছে বিবৃতি দিয়ে সঠিক তথ্য যত শীঘ্র সম্ভব জানাবেন এবং তার সকল কপি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা, পুরানা পল্টন, ঢাকা এই ঠিকানায় পাঠাবেন এবং ঢাকার মহিলাদের জ্ঞাতার্থে জানানো হচ্ছে যে, তাঁরা আওয়ামী লীগের সদর দপ্তর পুরানা পল্টনে এসে মহিলা কর্মীদের কাছে সরাসরি তথ্য পরিবেশন করতে পারেন।
এ সবের প্রেক্ষিতে মহিলারা এগিয়ে আসেন এবং ৭ জানুয়ারি গঠন করে ‘কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা’। সুফিয়া কামালকে সভাপতি, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের শাহেরা আহমদকে সম্পাদক এবং সংসদ সদস্য তসলিমা আবেদকে কোষাধ্যক্ষ করে এই সংস্থা গঠিন হয়। লাঞ্ছিতাদের জন্য তারা যে আশ্রয়গৃহ করেছিলেন তার মেট্রন নিযুক্ত হন হাজেরা খাতুন।
সংস্থার প্রতিনিধিরা এরপর স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী কামরুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তিনি তাদের সম্পূর্ণ আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। শুধু তাই নয় ইস্কাটনে [২০ ও ৮৮নং] দুটি বাড়িও বরাদ্দ দেন সেখানে আশ্রয়গৃহ খোলা যায়।
আসলে সময়টা ছিল মূল্যবান। অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল যার উল্লেখ আছে নীলিমা ইব্রাহীমের বইয়ে। অনেককে পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতে পাচার করে দেয়ার সম্ভাবনা ছিল। অনেকে তো আত্মহত্যাও করছিল।
বঙ্গবন্ধু এর মধ্যে ফিরে এসেছেন। তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীদের পুনর্বাসনে পরিকল্পনা নেন। বদরুননেসা আহমেদ ও নুরুজাহান মুরশিদকে তিনি দায়িত্ব দেন একটি পরিকল্পনা প্রণয়নেÑ সেখানে শুধু বীরাঙ্গনারা নয়; যারা পরিত্যক্ত, আশ্রয়হীন, বিধবা, অসহায় তাদেরও যেন পুনর্বাসন করা যায়।
এ পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করে। এটি ছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত একটি স্বায়ত্তশাসিত বোর্ড। এ বোর্ডের সভাপতি করা হয় বিচারপতি কেএম সোবহানকে। বোর্ডে বিচারপতি, লেখিকা জনপ্রতিনিধি ছাড়াও ছিলেন সদ্য বিধবারা।
সরকার থেকে ১০ কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যÑ ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যা ছিল বিরাট অঙ্কের টাকা। জনাব আবদুল আওয়ালকে কর্মসূচীর প্রধান করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তকর্তা সৈয়দ জাহাঙ্গীর হায়দারকে প্রশাসনিক পরিচালক ও শহীদ এমপি মামুন মাহমুদের স্ত্রী মোশফেকা মাহমুদকে করা হয় ফিন্যান্স ডিরেক্টর।
সুফিয়া কামাল ও অন্যরা যে বোর্ড গঠন করেছিলেন এবং তার অধীনে জেলায় জেলায় যে কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন তা তারা হস্তান্তর করেন নতুন বোর্ডের কাছে। তবে ইস্কাটনের বাড়ি দু’টি রেখে দেন তাদের গৃহীত কর্মসূচীর জন্য। তারাও কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান করছিলেন। এক প্রতিবেদন অনুসারে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে তারা ৩০০ জনকে এনেছিলেন, যাদের মধ্যে ৫০ জনকে ১৫ দিন পরই পরিবারের আশ্রয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
পুনর্বাসন বোর্ড পুর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করে। এ কাজের জন্য নিবেদিত কর্মীও বোর্ড পেয়েছিল। সংস্থার প্রথম কাজ ছিল বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে জরিপ করা ও তাদের চিকিৎসার বন্দোবন্ত করা। পুনর্বাসনতো আছেই।
এ উদ্দেশ্যে সংস্থা সারাদেশে ২২টি সেবা সদন প্রতিষ্ঠা করে। বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। এসব সেবামূলক কাজে প্রভূতভাবে সহায়তা করে মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টার মার্গারেট মেরি, আইপিপিএফ-এর ডা. জিওফ্রে ডেভিস এবং ওডার্ট অল গুলজ।
পুনর্বাসন বোর্ডকে ধানম-ির ৩নং রোডে একটি বাড়ি বরাদ্দ করা হয় যেখানে একটি বিশেষায়িত ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। আইপিপিএফ-এর ডা. ডেভিস এ কাজে সবচেয়ে সহায়তা করেন। সরকার কাজের আইনগত বাধা দূর করতে নির্দেশ দেন, যারা অবরুদ্ধ দেশে ধর্ষিত হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অ্যাবর্শন আইন প্রযোজ্য হবে।
এরপর আসে যুদ্ধ শিশুদের কথা। অধিকাংশ মহিলাই গর্ভপাত করাতে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, জানিয়েছেন ডা. ডেভিস। আমাদের কেস স্টাডিগুলোও তার প্রমাণ। ধনীরা মহিলাদের কলকাতায় পাঠিয়ে দিতেন গর্ভপাতের জন্য। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.