প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন by সরদার সিরাজুল ইসলাম

সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচী পালন করা হবে কি-না প্রশ্নে আলোচনা হলে অধিকাংশ সদস্য বিরোধিতা করে অবশ্য অলি আহাদ, আবদুল মতিন প্রমুখ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে জোরালোভাবে মতপ্রকাশ করে।
১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে যুক্তি ছিল এই যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মুসলিম লীগ সরকার এই অজুহাতে ১৯৫৩ সালের প্রস্তাবিত নির্বাচন বাতিল করে দিলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রাসঙ্গিকক্রমে উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনদিনের জন্য ময়মনসিংহ, পাবনা ও কুমিল্লা সাংগঠনিক সফরে থাকায় (২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা ফেরেন) ওই সভায় অথবা ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মকা-ে যোগ দিতে পারেননি। এইকভাবে আতাউর রহমান খান মামলা সংক্রান্ত নিজ পেশার কাজে ময়নসিংহ কোর্ট ২০ ও ২১শে ফেব্রুয়ারি ব্যস্ত থাকায় এইসব কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত পরে গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রবাসের নেতৃস্থানীয় ছাত্ররা ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলের মধ্যবর্তী পুকুর পাড়ে এক সভায় মিলিত হয়। আব্দুল মোমিনের সভাপতিত্বে ওই সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত জিল্লুর রহমান, গাজীউল হক, হাবিবুর রহমান শেলী, মোহাম্মদ সুলতান, এম, আর আখতার মুকুল, কমরুদ্দিন আহম্মদ, এএ বারী এটি, আনোয়ারুল হক খান প্রমুখ। সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ২১ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত কর্মসূচী পালন করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
২০ ফেব্রয়ারি রাতে মুসলিম লীগ প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি এবং প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটির সভায় অধিকাংশ সদস্যরা বাংলা ভাষাকে স্বীকার করে নিয়ে বিবৃতি দেয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে কিন্তু স্বরাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারি আজফারের বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি।
একুশে ফেব্রয়ারি কর্মসূচী পালনের প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আটক আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিকে প্রদেশের সর্বত্র সভা-শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ রহমতুল্লাহ ক্লাবে শামসুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখেন শামসুজ্জোহা, মফিজুদ্দিন আহম্মদ আলমাস আলী প্রমুখ। সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা এবং শেখ মুুজিবের মুক্তি দাবি করা হয়। শেখ মুজিব ঢাকা জেলে অনশন শুরু করেন ১৬ ফেব্রুয়ারি। তাকে অনুসরণ করেন মহীউদ্দিন আহম্মদ। ১৮ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব ছাত্রদের এক চিঠি লেখেন। এই চিঠি পেয়ে পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় যাতে সভাপতিত্ব করেন মোখলেসুর রহমান এবং বক্তব্য রাখেন জিল্লুর রহমান, নাদেরা বেগম, শামসুল হক চৌধুরী প্রমুখ। সভায় শেখ মুজিব ও মহীউদ্দিন আহম্মদের মুক্তি দাবি করা হয় এবং গাজীউল হককে আহ্বায়ক করে বিশ্ববিদ্যালয় রাজবন্দী মুক্তি কমিটি নামে একটি কমিটি গঠিত হয়। এছাড়া শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে পোস্টারিং হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানীসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশে এক স্মারকলিপি পেশ করেন যার ওপর ভিত্তি করে ইত্তেফাক প্রতিবেদনে বলা হয়, “পাকিস্তান সংগ্রামের জঙ্গী কর্মী, ছাত্র-যুব আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বিনা বিচারে দীর্ঘ কারাবাস ও বন্ধ দিনগুলির নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে জীর্ণ স্বাস্থ্যের জন্য উৎকণ্ঠা ও ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলিয়া প্রদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই প্রদেশের সব রাজনৈতিক কর্মী বিশেষ করিয়া শেখ মুজিবুর রহমান ও মহীউদ্দিন আহম্মদের আশু মুক্তির প্রশ্নে পূর্ববঙ্গ পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশে এক আবেদন পেশ করিয়াছেন। স্বাক্ষরকারীগণ বলেন, সর্বশক্তি নিয়োজিত করিয়া আপনারা পাকিস্তানে আইন ও নীতির শাসন, সৌভ্রাতৃত্ব ও গণতন্ত্র কায়েম করুণ। ব্যবস্থা পরিষদে জুলুমের বিরুদ্ধে নির্ভীক সভ্য নিষ্ঠার, স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে আইনানুগত্যের ফ্যাসিস্ট অত্যাচার ও আমলাতান্ত্রিক হামলার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আজাদীর দাবি তুলুন। জালেম সরকারের কব্জাকে কাবু করিয়া ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ ও আন্দোলন গড়িয়া তুলিয়াই আমরা কারাপ্রাচীরের অন্তরালের দেশ-দরদিদের মুক্ত আলো বাতাসে ফিরিয়া পাইব। আসুন আপনারা পরিষদের ভিতরে আর আমরা বাহিরে পূর্ববঙ্গের রাজবন্দীদের বিশেষ করিয়া শেখ মুজিবুর রহমানা ও মহীউদ্দিন আহম্মদের মুক্তি দাবিতে আওয়াজ তুলি।”
আবেদনপত্রে মওলানা ভাসানী ছাড়াও স্বাক্ষর করেন আতাউর রহমান খান, মাওলানা রাগীর আহসানÑ সভাপতি জমিয়তে ইসলাম, নুরুল হুদা- সভাপতি লেবার ফেডারেশন, আব্দুল হামিদ প্রাক্তন সম্পাদক বঙ্গীয় মুসলিম লীগ, কফিলউদ্দিন চৌধুরী সম্পাদক, ঢাকা বার সমিতি, মির্জা আব্দুল কাদের- সভাপতি চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী সমিতি, সামসুল হক- সম্পাদক আওয়ামী মুসলিম লীগ, কমরুদ্দিন আহম্মদ- সভাপতি পূর্বপাক ফেডারেশন অব লেবার, আব্দুস সালাম- সম্পাদক পাকিস্তান অবজারভার, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা- সম্পাদক, ইত্তেফাক, জহিরুদ্দিন আহম্মদ- প্রাক্তন সালার-ই-সুবা, হাসান ইকবাল সম্পাদক সৈনিক, সিরাজুদ্দিন আহম্মদ- সহযোগী সম্পাদক ইনসাফ, কাজী গোলাম মাহবুব- আহ্বায়ক সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ, শওকত আলী। এছাড়া পূর্ববাংলা ছাত্রলীগ সভাপতি, সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, যুবলীগের সম্পাদক, তমুদ্দিন মজলিশ সম্পাদক, বিভিন্ন ছাত্র সংসদ কর্মকর্তা, ডিস্ট্রিস্ট বোর্ড সদস্য, মিউনিসিপাল কমিশনাররাও আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করিয়াছেন।”
পূর্বদিনের ১৪৪ ধারা জারি সত্ত্বেও ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের লক্ষ্যে নির্ধারিত কর্মসূচী মোতাবেক খুব সকাল থেকেই (বৃহস্পতিবার) ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। আমতলায় ছাত্র সভা শুরু হওয়ার পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রাক্তন অধ্যাপক মোজাফফর আহম্মদ চৌধুরী, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোল্ট ডক্টর ওসমান গণী, কলা অনুষদের ডিন ডক্টর জুবেরি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ ডক্টর নিউম্যান, দর্শন বিভাগের ডক্তর গোলাম জিলানি প্রমুখ ঘটনাস্থলে আসেন এবং ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার অনুরোধ জানান। কিন্তু ছাত্ররা বরং উপচার্যকে তাদের সভায় সভাপতিত্ব করতে বলেন। উপাচার্য অবশ্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করলে সভাপতিত্ব করতে রাজী আছেন বলে জানান। ইতোমধ্যে খবর আসে যে লালবাগ এলাকায় স্কুল ছাত্ররা মিছিল বের করে এবং পুলিশ তাদের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে। ফলে আহত ছাত্রদের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। ছাত্ররা এতে আরও উত্তেজিত হয়। শিক্ষকদের অনুরোধ উপেক্ষা করে বেলা ১০টা নাগাদ ছাত্ররা এক সভায় মিলিত হয়। এম আর আখতার মুকুলের প্রস্তাবক্রমে গাজীউল হক সভাপতিত্ব করেন। সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখলে সভায় সিদ্ধান্ত মতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য প্রস্তুতি নেন। ১৪৪ ধারা কিভাবে ভঙ্গ করা হবে সে বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছাত্রদের কাছে আবদুস সামাদ প্রস্তাব করেন যে ১০ জন করে এক এক ব্যাচ বের হতে হবে। সভায় এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরেই সভা ভঙ্গ হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য ছাত্ররা এগোতে থাকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সম্ভাব্য পরিণতি গ্রেফতার সম্বন্ধে ছাত্ররা একরকম নিশ্চিত ছিল আর সেজন্য এসব ছাত্রছাত্রীর নাম ও ঠিকানা লিখে রাখার ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং এজন্য মোহাম্মদ সুলতান, হাসান হাফিজুর রহমান ও আজহারকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সিটি ডিএসপি সিদ্দিক দেওয়ানের নেতৃত্বে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ মাহমুদের নেতৃত্বে টহল চালিত হয় ঢাকা শহরে। সকাল নয়টা নাগাদ ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মাহমুদ ইদরিসা বিশ্ববিদ্যালয় গেটের সামনে অবস্থান নেন।
হাবিবুর রহমান শেলীর নেতৃত্বে প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী দলটি রাস্তায় নামে। এর পরে বের হন ইব্রাহিম তাহা, আব্দুস সামাদ, আনোয়ারুল হক খান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রমুখ শাফিয়া খাতুন, সুফিয়া ইব্রাহিম, রওশনআরা বাচ্চু, শামসুন্নাহারসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রীও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গেটের বাইরে যান। এর পরে যান এস এ বারী, শামসুল হক, আনোয়ারুল আজীম, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, সৈয়দ ফজলে আলী বদরুল আমীন প্রমুখ।
পরবর্তীতে এই মিছিলের গতি এত দ্রুত হয় যে নাম লিখে রাখা আর সম্ভব হয়নি। ছাত্ররা গ্রেফতার বরণ প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের পুলিশ গ্রেফতার করে তাদের গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যায়। তবে কোন ছাত্রীকে গ্রেফতার করা হয়নি। গ্রেফতারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ এক বিব্রত অবস্থায় পতিত হয় এবং বিনা উস্কানিতে লাটিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে প্রবেশ করে ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। অনেক ছাত্র মেডিকেল কলেজের দিকে যায় আবার শত শত ছাত্র পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহম্মদ চৌধুরী ও অন্যান্য শিক্ষকরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত জেলা মেজিস্ট্রেট কোরাইসির কাছে পুলিশেল অমানুষিক নির্যাতনের তীব্র প্রতিবাদ জানালে জেলা মেজিস্ট্রেট তাদের এক পর্যায়ে তোমাদের মতো অনেক লোক আমার পকেটে আছে, বলে উপহাস করে। বেলা প্রায় ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে শিক্ষকদের মাঝে উপস্থিত হন, উপচার্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন এবং ছাত্রদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন। অপরদিকে ছাত্ররা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ইটপাটকেল বিনিময় শুরু হয়। ছাত্ররা মেডিক্যাল কলেজ হোসটেল, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেল থেকে দলে দলে পরিষদ ভবনের (বর্তমান জগন্নাথ হল) দিকে এগোতে চেষ্টা করে যদিও তা পূর্বেই ইপিআর এবং পুলিশ ঘেরাও করে রাখে।
(ক্রমশ.)

No comments

Powered by Blogger.