প্রাণ দিল সাহসী পুলিশ ॥ চুরি করা ট্রান্সফরমার যেত গাজীপুরের কারখানায় by গাফফার খান চৌধুরী

 সারাদেশে প্রায় ২শ’ বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চোর সক্রিয়। চোররা নিজস্ব ট্রাক নিয়ে ট্রান্সফরমার চুরি করে। চুরি করা ট্রান্সফরমার চলে যায় গাজীপুর এলাকায় বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা একটি কারখানায়।
কারখানাটি রবিবার রাতে সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। ওই কারখানায় ট্রান্সফরমার ভাঙ্গা হত। ট্রান্সফরমারের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন জিনিসপত্র। ট্রান্সফরমার চোরদের হাতে ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা খুনের ঘটনায় আরও ৩ জনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ নিয়ে ডিবি কর্মকর্তা খুনের ঘটনায় ৪ জনকে আটক করা হলো। আর সাহসী পুলিশ কর্মকর্তাকে সার্বিকভাবে সহায়তা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আটককৃতদের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে খুনের সঙ্গে জড়িত না থাকায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আটককৃতরা ট্রান্সফরমার চুরি সর্ম্পকে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। রবিবার সকাল সোয়া ৬টায় বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চোরদের ঢাকা থেকে ধাওয়া করে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানা এলাকায় চোরদের রডের আঘাতে মারাত্মক আহত হন ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক শরীফুল ইসলাম খান। এ সময় পুলিশের সঙ্গে চোরদের গুলি বিনিময় হয়। পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শিপন (২৭) নামে এক চোরকে গ্রেফতার করে। আহত গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সকাল সাড়ে ৮টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় শরীফুলের মুত্যু হয়।
চোরের হাতে গোয়েন্দা কর্মকর্তা খুনের ঘটনায় সারাদেশে রীতিমত তোলপাড় শুরু হয়। শুরু হয় অভিযান। রবিবার রাতেই অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, শনিবার রাতে ২টি গাড়িতে করে ১১ সদস্যের ডিবির একটি দল অভিযান চালায়। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় যাওয়ার পর তাদের গাড়ি ট্রান্সফরমারসহ ট্রাকটিকে বেরিকেড দিয়ে রাস্তার ওপরে আটকে ফেলে। এ সময় শরীফুল ট্রাকের ভেতরে তল্লাশি চালাতে যায়। ওই সময় ট্রাকের ভেতরে ভূষির বস্তার ফাঁকে শুয়ে থাকা চোরেরা লোহার রড ও বড় ছুরি দিয়ে শরিফুলকে আঘাত করেই দ্রুত ট্রাক টান দেয়। সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালাতে থাকে পুলিশ। চোরেরাও গুলি চালাতে থাকে। এক পর্যায়ে চোর শিপনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। কিন্তু পালিয়ে যায় অন্য চোরেরা।
ডিবি পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মশিউর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, শিপনের তথ্যমতে রাতেই গাজীপুরে অভিযান চালানো হয়। আবিষ্কৃত হয় বহুল আলোচিত সেই চোরাই কারখানা। কারখানাটি গাজীপুরের কোনাবাড়ির বাইমাইল এলাকার নতুনবাজার নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত বহুতল এফএফ টাওয়ারের পাশেই বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে। কারখানাটি প্রায় ৩ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। কারখানায় রয়েছে একাধিক গেট। কারখানাটি অন্তত এক যুগেরও অধিক সময় ধরে চোরাই ট্রান্সফরমার বেচাকেনা ও ট্রান্সফরমার ভেঙ্গে তার যন্ত্রাংশ আলাদা আলাদাভাবে বিক্রি বা অন্যান্য জিনিসপত্র তৈরির কাজ করে আসছিল। প্রথমেই কারখানার চারদিকে অবস্থান নেয়া হয়। এরপর কারখানায় চালানো হয় অভিযান। অভিযানকালে ছোট্ট একটি পকেট গেট দিয়ে পালানোর সময় অন্তত আধা কিলোমিটার দৌঁড়ে স্থানীয়দের সহায়তায় আটক করা হয় কারখানার দীর্ঘদিনের কর্মচারী জুয়েল (২৮) ও আনোয়ারকে (৩৫)। আটককৃতরা প্রকাশ করে দেয় ট্রান্সফরমার চুরির রহস্যময় কাহিনী।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও জানান, কারখানার মালিক এক সময় ট্রান্সফরমারের ব্যবসা করত। কিন্তু বৈধ পথে ব্যবসার চেয়ে অবৈধ পথে ব্যবসায় লাভ বেশি। তাই নেমে পড়ে ট্রান্সফরমার চুরির ব্যবসায়। কারখানা মালিককে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে তদন্ত এবং গ্রেফতারের স্বার্থে মালিকের নাম প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তিনি। কারখানা মালিকের রয়েছে ৫টি নিজস্ব ট্রাক। এসব ট্রাক দেড়টন, ২ টন, ৩ টন ও ৫ টন ধারণা ক্ষমতাসম্পন্ন। প্রতি রাতেই একেকটি ট্রাক ১০ থেকে ১২ চোরের একটি দল নিয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর তারা গাজীপুরের কোনাপাড়া একটি স’মিল থেকে কাঠের ভূষি কিনে। প্রতিটি ট্রাকের জন্য ১৫ থেকে ২০ বস্তা ভূষি কেনা হয়। একেক বস্তা ভূষির দাম ২শ’ টাকা। এসব ভূষির বস্তা ট্রাকের ভেতরে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়।
পরে ভূষি বিক্রেতা আব্দুস সালামকে (৩৫) গাজীপুরের কোনাপাড়ার স’মিল থেকে আটক করা হয়। আব্দুস সালাম গোয়েন্দাদের জানায়, গ্রেফতারকৃত চোরেরা মুরগির খামারে ব্যবহারের কথা বলে তার কাছ থেকে প্রতিবস্তা ২শ’ টাকায় কিনে নেয়। কিনে নেয়া ভূষির বস্তা চুরির কাজে ব্যবহৃত হয় এটি তার জানা নেই। পরে আব্দুস সালামকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মুক্তি দেয়া হয়।
চোর চক্রের রয়েছে অগ্রবর্তী ২টি দল। একটি দল মাইক্রোবাস নিয়ে বিভিন্ন এলাকা টহল দেয়। তারা কোথায় কোথায় সুবিধাজনক জায়গায় ট্রান্সফরমার রয়েছে তা আগাম পর্যবেক্ষণ করে। এরপর দ্বিতীয় ধাপের দলটি কাজ শুরু করে। এ দলটি প্রাইভেটকার নিয়ে কেতাদুরস্ত অবস্থায় আগের দলের পর্যবেক্ষণ করা ট্রান্সফরমারের কাছ দিয়ে চলাফেরা ও পর্যবেক্ষণ করে যেন কোন বিদ্যুতের পদস্থ কর্মকর্তা সরেজমিন ট্রান্সফরমারের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে এসেছেন। এতে সাধারণ মানুষ কোন কিছু তেমন টের পান না, তেমনি ন্যূনতম আন্দাজও করতে পারেন না।
রাত হওয়া মাত্রই শুরু হয় অপারেশন। ট্রাক নিয়ে চোরের দল ঠিক ট্রান্সফরমার যে খুঁটির সঙ্গে থাকে সেই খুঁটির নিচে রাখে। এরপর ২/৩ চোর দ্রুত সেই ট্রান্সফরমারের কাছে বিদ্যুতরোধক পোশাক পরে ও তার কাটার যন্ত্রপাতি নিয়ে খুঁটি বেয়ে ট্রান্সফরমারে উঠে যায়। তারা প্রথমেই ট্রান্সফরমারটিকে শক্ত রশি দিয়ে খুঁটির উপরের দিকে পাটাতনের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। এরপর তার কেটে দিয়ে আস্তে আস্তে রশি দিয়ে কপিকলের মতো করে নিচে ট্রাকের ওপর রাখা ভূষির বস্তার উপর নামানো হয়। ভূষির বস্তা রাখার একটি বিশেষ কারণ হচ্ছে সাবধানতা। অনেক সময় অসাবধানতাবশত ট্রান্সফরমার জোরে পড়ে গেলেও নরম ভূষির বস্তার কারণে শব্দ হয় না। ফলে চোরদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে না।
এরপর ট্রান্সফরমার ভূষির বস্তা দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাওয়া হয় গাজীপুরের ওই কারখানায়। রাস্তায় পুলিশ ধরলেও কোন সমস্যা নেই। কারণ ট্রাকে ভূষির বস্তা রয়েছে। ভূষি কেনা বাবদ স’মিলের রশিদ দেখায়। ফলে পুলিশ আর বিষয়টি সন্দেহ করতে পারে না বা ট্রাকে তল্লাশি চালানোর প্রয়োজনীয়তাও অনেক সময়ই মনে করে না।
এরপর সোজা ট্রাকটি চলে যায় গাজীপুরের সেই কারখানায়। সেখানে ট্রান্সফরমার রাখা হয়। ট্রান্সফরমার ভেঙ্গে তার আলাদা করা হয়। তামার তার গলিয়ে প্রতি কেজি ৫শ’ টাকা দরে বিভিন্ন তামার তার উৎপাদনকারী কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়। অন্যান্য যন্ত্রাংশ আলাদা করে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়ে থাকে। একেকটি ট্রান্সফরমার প্রায় ২০ থেকে ২২ লাখ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। অনেক সময় চাহিদার কারণে বেশি দামেও বিক্রি হয়ে থাকে।
কোম্পানি মালিকের সারাদেশে প্রায় ২শ’ ট্রান্সফরমার চোর রয়েছে। এসব চোর মাসিক বেতনে কোম্পানিতে চাকরি করে থাকে। প্রতি চোর দৈনিক ৫শ’ টাকা পেয়ে থাকে। এই ৫শ’ টাকা নির্ধারিত। ট্রান্সফরমার চুরি করতে পারলেও পাবে, আর না পারলেও পাবে। আবার চুরি করতে পারলে ট্রান্সফরমার বিক্রির লাভের একটি অংশ চোরদের দিয়ে থাকে কারখানা মালিক।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম বিভাগের উপ-কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, কারখানা মালিকের এমন তৎপরতার কারণে অনেক চোর নিজস্ব অর্থায়নে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এসব সিন্ডিকেটের নিজস্ব ট্রাকও রয়েছে। কারখানা মালিককে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যেই শনাক্ত হওয়া কারখানাটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। কারখানায় থাকা ৯টি সচল ট্রান্সফরমারসহ ভেঙ্গে ফেলা অন্যান্য ট্রান্সফরমারের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ জব্দ করা হয়েছে। ট্রান্সফরমার চুরির ফলে গ্রামেগঞ্জে বিদ্যুত থাকছে না। ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ছে। আর মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কারণ সারাদেশে এসএসসি, মাদ্রাসা বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা চলছে। স্বাভাবিক কারণেই ট্রান্সফরমার চুরি হওয়ায় বিদ্যুত না থাকার ফলে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। আর বিদ্যুত না থাকায় সরকারের ওপর সাধারণ মানুষ নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে দেশ ও জাতির ওপরে। ট্রান্সফরমার চুরির বিষয়টি নিছক চুরি নাকি এর পেছনে আরও কোন উদ্দেশ্য আছে তা জানার চেষ্টা চলছে।

No comments

Powered by Blogger.