সাকা চৌধুরীর হাতে যারা ধরা পড়েছে তারা কেউ বাঁচেনি- যুদ্ধাপরাধী বিচার- প্রসিকিউশনের ১৮তম সাক্ষীর জবানবন্দী

 একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ১৮তম সাক্ষী সোমবার জবানবন্দী পেশ করেছেন।
জবানবন্দীতে সাক্ষী দেবব্রত সরকার বলেন, ১৯৭১ সালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর হাতে যারা ধরা পড়েছে তাদের অনেকে বেঁচে গেছে। কিন্তু সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর হাতে যারা ধরা পড়েছে তারা কেউ বাঁচেনি। আমি আমার বাবা এবং জেঠুদের হত্যার বিচার চাই। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তিনি এই জবানবন্দী প্রদান করেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
এদিকে চাচার মৃত্যুর কারণ দেখিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর প্যারোলে মুক্তির আবেদন করা হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি আরেক নেতা আব্দুল আলীমের বিরুদ্দে ১০ সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হবে ১১ ফেব্রুয়ারি। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ প্রসিকিউশন পক্ষের আবেদনে এ দিন নির্ধারণ করেছেন।
১৮তম সাক্ষী ॥ প্রসিকিউশনের সাক্ষী তাঁর জবানবন্দীর শুরুতেই বলেন আমার নাম দেবব্রত সরকার। পিতা মৃত অরবিন্দ সরকার। গ্রাম আধার মানিক, ডাক নতুন বাজার, থানা রাউজান, জেলা চট্টগ্রাম। ১৯৭১ সালে আমার বয়স অনুমান ১০ বছর ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমরা চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাই। আমার মেজ জেঠু মতিলাল চৌধুরী শহরের বাসায় থেকে গিয়েছিলেন। তাঁকে আনার জন্য আমার বাবা, জেঠু অরুণ বিকাশ চৌধুরী, জোগেশ দে, শান্তি কুসুম চৌধুরী, বাবার বন্ধু পরিতোষ দাস, শহরের বাসায় গেলেন এপ্রিল মাসের চার অথবা পাঁচ তারিখ। সেদিন ছিল শনিবার। শহরের বাসা ছিল খাতুনগঞ্জে।
তিনি বলেন, পরের দিন আমার জেঠু মতিলাল চৌধুরীর পাচক সুনীলকে রক্তাক্ত অবস্থায় কয়েকজন লোক আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এল। সুনীলের মুখে শুনলাম- যেদিন আমার বাবা এবং জেঠুরা খাতুনগঞ্জের বাসায় গেল সেদিন রাতে পাশের বাসার আব্দুস সোবহান এসে আমার বাবা এবং অন্যদের বলল আপনারা এখানে কি করছেন। কোন ষড়যন্ত্র করছেন কিনা। এ কথা বলে সোবহান বেরিয়ে গেল।
সাক্ষী বলেন, এর ১৫/২০ মিনিট পর পাকিস্তান আর্মির গাড়ি এল। আমার বাবা, তাঁর সঙ্গে যাওয়া অন্য পাঁচজন এবং সুনীলসহ মোট সাতজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় চৌধুরীর পাহাড়ে। ফজলুল কাদের চৌধুরীর পাহাড়ের বাড়িতে নিয়ে যায়। পাহাড়ের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর সুনীলকে ছেড়ে দেয়। সে খাতুনগঞ্জের বাসায় ফিরে আসে। সে আব্দুস সোবহানকে দেখতে পায়। আব্দুস সোবহান তাঁকে বলে তুইতো একজন বড় সাক্ষী। তোকে রাখা যাবে না। এ কথা বলে সে ক্রিচ/তলোয়ার দিয়ে কোপাতে থাকে। আব্দুস সোবহানের মা এসে সুনীলকে উদ্ধার করে লোকজন দিয়ে গ্রামের বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা করে।
তিনি বলেন, রাত ১১টা সাড়ে ১১টার দিকে অলিমিয়া হাট থেকে দুই জন লোক এসে বলল ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নির্দেশ দিয়েছে যে, আমাদের গ্রামের বাড়িতে কোন পুরুষ লোক রাখা যাবে না। ওই দুই জন আসার আগেই বাড়ির সব পুরুষ লোক আশপাশের বৌদ্ধদের বাড়িতে টেম্পলে আশ্রয় নেয়। দেবব্রত সরকার বলেন, আমার ঠাকুরদাদাসহ আমরা যারা বাড়িতে ছিলাম তারা রাতে পাশের বৌদ্ধদের বাড়িতে আশ্রয় নেই। আমরা চলে যাওয়ার পরদিন সকালে বাড়িতে লুটপাট করে আগুন দেয়। এরপর আমরা সাব্রুম হয়ে কলকাতার সল্ট লেকে চলে যাই।
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথমে আমরা দুই ভাই মামার সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানজি বাসায় আসি। এসে দেখি বাসার কোন চিহ্ন নেই। ভিটা খালি। আমরা আমাদের বাবা চাচাদের খোঁজা খুঁজি করি। অনেকে বলে তাদের পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকে বলে তাদের টর্চার সেলে নির্যাতন করে মেরে কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর আমরা গ্রামের বাড়িতে চলে যাই।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর হাতে যারা ধরা পড়েছে তাদের অনেকে বেঁচে গেছে। কিন্তু সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর হাতে যারা ধরা পড়েছে তারা কেউ বাঁচেনি। আমি আমার বাবা এবং জেঠুদের হত্যার বিচার চাই। বুধবার ১৮তম ও ১০ ফেব্রুয়ারি ১৭তম সাক্ষীর (ক্যামেরা ট্রায়াল) জেরার দিন ধার্য করে দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। আসামি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আইনজীবীদের প্রত্যাহার করে নিয়ে নিজেই সাক্ষীদের জেরাসহ মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তিনি।
তাঁর মামলা পরিচালনার জন্য গত ৩১ জানুয়ারি এ্যাডভোকেট সালমা হাই টুনিকে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী (স্ট্যাট ডিফেন্স) হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ আইনজীবী রাষ্ট্রের খরচে সাকা চৌধুরীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করবেন। ট্রাইব্যুনালে ৩১ জানুয়ারি সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ১৭তম মহিলা সাক্ষীর ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়।
প্যারোলের আবেদন ॥ চাচার মৃত্যুর কারণ দেখিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর প্যারোলে মুক্তির আবেদন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে এ আবেদন করেছেন সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী।
ফারহাত কাদের চৌধুরীর করা ওই আবেদনে আজ অনুষ্ঠিতব্য চাচা ফজলুল সোবহান চৌধুরীর জানাজা ও দাফন কাজে অংশ নিতে ওই দিন সাকা চৌধুরীকে প্যারোলে মুক্তি দানের আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর ওই আবেদন করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.