সংঘাত আতঙ্ক হরতাল

চারদিকে সংঘাত। সহিংসতা। রাজপথে উত্তেজনা। সংঘর্ষ। কারাবন্দি নেতাদের মুক্তির দাবিতে বেপরোয়া জামায়াত-শিবির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাসনে থাকা ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ফিরতে মরিয়া।
রাজধানীসহ দেশজুড়ে হামলা, ভাঙচুর। ধারাবাহিকতায় আজ সারা দেশে জামায়াতের হরতাল। গত তিন দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ককটেল ফুটিয়ে উপস্থিতি জানান দিয়েছে ছাত্রদল। প্রস্তুত ছাত্রলীগও। রাত জেগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথগুলো পাহারা দিচ্ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিরোধী দল ও জোটের রাজপথের আন্দোলন, মিছিল-পিকেটিং মোকাবিলায় কঠোর নির্দেশনা পৌঁছেছে সরকারি শিবিরেও। রাজপথে শক্ত অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগকে। সহযোগী সংগঠনগুলোও থাকবে রাজপথে। যথাপ্রস্তুতি নিয়ে সড়কে থাকবেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সোমবার রাজধানীতে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের পর পুলিশের শীর্ষ পদে বড় ধরনের রদবদল করা হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের কর্মসূচি ঠেকাতে তাদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। হরতালের সময় কোথাও সহিংসতার আলামত ও সন্দেহজনক জটলা দেখলেই ছররা গুলি ছুড়তে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে সরকার ও প্রশাসনের কঠোর অবস্থান থাকলেও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কারাবন্দি নেতাদের বিচারের ক্ষণ ঘনিয়ে আসায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জামায়াত-শিবির। রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শনে ২২ জেলা থেকে নেতাকর্মীদের ঢাকায় আনা হয়েছে। ছাত্রশিবিরের একাধিক বিবৃতিতে তাদের চরম আন্দোলনের কথা জানানো হয়েছে। জামায়াতের আজকের হরতালে বিএনপিও সমর্থন দিয়েছে। রাতে দলটির পক্ষ থেকে হরতালে সমর্থন দেয়ার কথা জানানো হয়। রাজধানীতে গতকাল থেকে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যেই দুটি স্থানে মিছিল করে ছাত্রশিবির। ঢাকায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বার্ষিক ভোজ অনুষ্ঠান এবং চট্টগ্রামে বিপিএল-এর খেলা থাকায় এ দুই মহানগরে অর্ধদিবস হরতাল পালন করা হবে বলে জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সমাবেশের অনুমতি না দেয়ায় হরতাল: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ, জনদুর্ভোগ লাঘব ও আটক নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিল জামায়াত। এ উপলক্ষে দলের ঢাকা মহানগর শাখার উদ্যোগে বিকাল ৩ টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশ ও মিছিলের ঘোষণা দেয়া হয়। সমাবেশের অনুমতি চেয়ে সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন দেয়া হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে এই সমাবেশের অনুমতির না পেয়ে তাৎক্ষণিক হরতাল পালনের ঘোষণা দেয় তারা। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে এটা জামায়াতের দ্বিতীয় দফা হরতাল। এর আগে একই ইস্যুতে ৪ঠা জানুয়ারি প্রথমবারের মতো এককভাবে হরতাল পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে ১৮ দলীয় জোটের শরিক দলটি। অবশ্য বিভিন্ন ইস্যুতে গতকাল কমপক্ষে ৫টি জেলায় হরতাল পালন করেছে জামায়াত-শিবির।
এদিকে জামায়াতের হরতাল কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ফের বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানীর স্পর্শকাতর এলাকা হিসেবে পরিচিত পুরানা পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, মতিঝিল, প্রেস ক্লাব, বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেট, মগবাজার, মালিবাগ, বিজয়নগর, কাকরাইলসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কলেজসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সামনে পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ‘শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি’ পালনের নামে জামায়াত-শিবির পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করে আসছে এমন অভিযোগ পুলিশের। এ কারণে বরাবরই জামায়াত-শিবিরের প্রকাশ্যে কর্মসূচি ঠেকাতে মরিয়া রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সর্বশেষ গত সোম ও মঙ্গলবার জামায়াত-পুলিশের সংর্ঘষের পর পুলিশকে আরও কঠোর অবস্থানে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে র‌্যাব-পুলিশের কঠোর অবস্থান জেনেও গতকাল রাজধানীর কমলাপুর, নয়াপল্টন, দোয়েল চত্বরসহ কয়েকটি স্থানে ঝটিকা মিছিল করেছে তারা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে জামায়াত-শিবির যেন ফের নাশকতা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য মঙ্গলবার রাত থেকেই তাদের কয়েক হাজার সদস্য মাঠে রয়েছে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। এসব চেকপোস্টে সন্দেহভাজন গাড়ি বিশেষ করে ব্যাগ বহনকারীদের তল্লাশি করা হচ্ছে। র‌্যাব পুলিশের বাড়তি তৎপরতায় গতকাল বিকাল থেকেই রাজধানী জুড়ে উদ্বেগ-উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল বিকালে রাজধানীর পুরানা পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলামোড়, মতিঝিলসহ রাজনৈতিক সহিংসপ্রবণ এলাকায় পুলিশের ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়। নিরাপত্তার কারণে পুলিশ এসব এলাকার ফুটপাথের সব দোকানপাট বন্ধ করে দেয়। তল্লাশি চালায় সন্দেহভাজন বিভিন্ন যানবাহনে। ৪-৫ জনের বেশি লোকজনকে রাস্তায় একেত্রে দাঁড়াতে দেয়নি। এতে হরতালের আগেই রাজধানী জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, সভা-সমাবেশ ও মিছিল করার গণতান্ত্রিক অধিকার দেশের সকল নাগরিকেরই রয়েছে। অথচ সরকার সম্পূর্ণ অন্যায় ও অগণতান্ত্রিকভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে জামায়াতকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে না দিয়ে নেতা-কর্মীদের ওপর চরম জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ ‘শিবির কর্মী দেখা মাত্রই গুলি করার’ নির্দেশ দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে সরকারের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। সরকারের এ জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। সরকারই জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে গণতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ করে দিয়ে আমাদের সর্বাত্মক আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকার বিচারের নামে প্রহসন করে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র করছে। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাতিল, জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও বিরোধীদলের আটক সকল নেতা-কর্মীদের মুক্তি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল, বিরোধী দলের উপর জুলুম-নির্যাতন বন্ধ, জনদুর্ভোগ লাঘবের দাবিতে আজ সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল পালনের আহ্বান জানান।
২২ জেলার বাছাই করা শিবির নেতাকর্মীরা ঢাকায়: ২২ জেলার বাছাই করা ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের ঢাকায় জড়ো করা হয়েছে। টার্গেট ট্রাইব্যুনাল। শীর্ষ নেতাদের বিষয়ে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত তাণ্ডব অব্যাহত থাকবে। নেতাদের মুক্তির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে আগ্রহী এমন শিবির নেতাদের নাম জমা দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। এখনও ব্যাপক মামলা হয়নি, হামলার ব্যাপকতা আরও তীব্র হতে পারে। পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করতেই হামলা করা হচ্ছে তাদের ওপর, এটা সংগঠনের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত। এছাড়াও ঢাকায় কর্তব্যরত পুলিশকে বিবেচনা করা হচ্ছে দলীয় ক্যাডার হিসেবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের গাড়ি বা বাড়িতে হামলা হতে পারে। শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি হয়ে গেলে জামায়াত ও ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ হবে- এটাকে নিশ্চিত মনে করেন শিবির নেতাকর্মীরা। গত ২৮শে জানুয়ারি রাজধানীতে গাড়ি ভাঙচুর, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত শিবির নেতাকর্মীরা রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ কালে পুলিশকে এমন তথ্যই দিয়েছে বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে। সূত্রমতে মানবতাবিরোধী অপরাধে আটক জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের রায় বানচাল করতে রাজধানী ঢাকা সহ বিভাগীয় শহরগুলোতে বিভিন্ন জেলা থেকে বাছাই করা শিবির কর্মীদের জড়ো করা হচ্ছে। ঢাকা শহরে তাদের আন্দোলন তীব্রতর করতে ঢাকায় আনা হয়েছে আশপাশের ২২ জেলার শিবির নেতাকর্মীদের। ঢাকায় তাদের হামলার টার্গেটও বদল করা হয়েছে। এর আগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হামলা ও মিছিল হলেও সামপ্রতিক সময়ে হামলার টার্গেট করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের আশপাশের এলাকা। ধীরে ধীরে তাদের আক্রমণের টার্গেট হয়ে উঠছে ট্রাইব্যুনাল। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, বি.বাড়িয়া ও নেয়াখালী জেলার ছাত্র শিবির নেতাকর্মীদেরকে ঢাকায় আনা হয়েছে। ওই সব জেলা ছাড়াও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটকে ঢাকায় আসার তলব করা হয়েছে। জানা গেছে, ওই সব জেলা ও ইউনিট থেকে এক শ’ জন বাছাই করা নেতাকর্মীকে আনা হয়েছে। সূত্রমতে যাদেরকে ঢাকায় আনা হয়েছে ওই সব নেতাকর্মীদেরকে আরও এক মাস আগে থেকেই বাছাই করে মোবাইলে এসএমএস করে তাদের নাম পাঠানো হয়েছে। ঢাকায় এসে কোন জেলা ও ইউনিট ঢাকার কোন নেতার অধীনে কাজ করবে সেটাও আগে নির্ধারণ করে তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ঢাকায় তাদের অবস্থানের বিষয়ে বলা হয়েছে জেলা শিবির কর্মীদের যাদের ঢাকা শহরে আত্মীয়রা বসবাস করে তাদেরকে আত্মীয়দের সঙ্গে থাকার কথা বলা হয়েছে। যাদের ঢাকায় কোন নিকট আত্মীয় নেই তাদেরকে রাখা হয়েছে ভাড়া করা ফ্ল্যাটে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিগত ৬ মাসে রাজধানী শহরের বিভিন্ন থানার জামায়াত নেতারা তাদের বাসা বদল করেছে। নতুন বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করলেও সূত্রমতে তারা কেউ আগের বাসা থেকে মালপত্র সরিয়ে নেয়নি। গোয়েন্দা সংস্থা মনে করছে বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মীদের ওই সব নতুন বাসায় রাখা হচ্ছে। এছাড়াও জামায়াত অনুসারী বেশ কিছু চিকিৎসক ও ব্যবসায়ী তাদের নিজস্ব ফ্ল্যাট বা বাড়ি থাকা সত্ত্বেও রাজধানীর বিভিন্ন মহল্লায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন, তাদের ভাড়া করা বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়েছে বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মীদের। রিমান্ডে থাকা বেশ কয়েকজন শিবির কর্মী জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন, তাদের বেশভূষারও পরিবর্তন করা হয়েছে যাতে সহজে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে শিবির হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে। এছাড়াও তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে রাজপথে নামার পর তাদের নির্দিষ্ট কাজ শুরু করার আগে পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে প্রয়োজনে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে এগিয়ে যেতে। সূত্রমতে মাওলানা আবুল কালাম আযাদের রায়ের দিনে শিবির কোন অ্যাকশনে না যাওয়ার কারণ হচ্ছে আবুল কালাম আযাদ বাচ্চুকে জামায়াত তাদের নিজস্ব লোক মনে করে না। তিনি জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত নেতা। গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী ও কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশকে তারা কার্যকর করতে দেবে না-এর জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও রাজি তারা।
সূত্রমতে রাজধানী শহর ছাড়াও দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতেও বাছাই করা শিবির কর্মীদের জড়ো করা হয়েছে আশপাশের জেলাগুলো থেকে। বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনাকে। ঢাকাতে মতিঝিল, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ফকিরাপুল, পুরানা পল্টন, নয়া পল্টন, কাঁটাবন, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, গুলিস্তান, চানখাঁরপুল এলাকাকে বিভিন্ন নামে ইউনিট হিসেবে ভাগ করে ধাপে ধাপে এক থেকে পাঁচ নম্বর ক্রমিক পর্যন্ত নেতার অধীনে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এক নম্বর ক্রমিকের নেতা গ্রেপ্তার হলে দ্বিতীয় ক্রমিকের নেতা ওই ইউনিট পরিচালনা করবে। এভাবে ৫ নম্বর ক্রমিকের নেতাও গ্রেপ্তার হয়ে গেলে দলের কেন্দ্র থেকে আবার ইউনিট পরিচালনার নেতার নাম জানিয়ে দেবেন। সূত্রমতে এসএমএস-এর মাধ্যমে জড়ো করা হচ্ছে নেতাদের। আবার এসএমএস- এর মাধ্যমে অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে সূত্রমতে কি ধরনের অ্যাকশন হবে সেটা কেবল ইউনিট পরিচালনাকারী একাই আগে জানবেন, কর্মীদের জানানো হয় নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো হওয়ার পর।
সন্দেহজনক জটলা দেখলেই গুলি: অস্ত্র থাকবে লোড করা। হাতের আঙুল থাকবে ট্রিগার পয়েন্টে। সন্দেহজনক জটলা মনে হলেই গুলি ছুড়তে হবে। জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা রোধে গতকাল এমন নির্দেশনা দিয়ে মাঠে নামানো হয়েছে অর্ধ লক্ষাধিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে হরতালে যে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা ও নাশকতা রুখতে সরকার দলীয় বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের সহযোগিতা চেয়েছে পুলিশ। এ লক্ষ্যে পাড়া-মহল্লায় বিশেষ বৈঠক হয়েছে। পুলিশের সহায়ক শক্তি হিসেবে সরকার দলীয় থানা ও জেলা ভিত্তিক নেতাকর্মীদের মাঠ দখলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে- পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাস্তায় হামলার আশঙ্কা দেখা দিলেই টিয়ারশেল ও গুলি ছুড়ে ছত্রভঙ্গের হুকুম দেয়া হয়েছে। ব্যাটালিয়ন ভিত্তিক বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ মজুত রাখতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনের সময় যাতে গুলি ফুরিয়ে না যায়। এছাড়া, গতকাল বিকাল থেকেই রাজধানীর স্পর্শকাতর অর্ধ শতাধিক পয়েন্টে দাঙ্গা পুলিশের পাশাপাশি ছদ্মবেশী গোয়েন্দাদের মোতায়েন করা হয়েছে। ২৬ পয়েন্টে বসানো হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। এর বাইরে ভোর থেকেই ১২ পয়েন্টে গোয়েন্দা ক্যামেরাম্যান নামানো হচ্ছে। গণমাধ্যম কর্মীবেশে পিকেটিং ও মিছিল অনুসরণ করবেন তারা। পয়েন্টগুলো হচ্ছে- যাত্রাবাড়ী মোড়, বিজয় সরণি পানির ট্যাংকি, নাইটিঙ্গেল, মিরপুর-১০ গোল চত্বর, শাহবাগ মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, মগবাজার ওয়্যারলেস মোড়, ইউসিবিএল ক্রসিং, ফার্মগেট, মালিবাগ রেল ক্রসিং ও শ্যামলী। স্পর্শকাতর পয়েন্ট হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে কূটনৈতিক এলাকা, জাতীয় সংসদ ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বইমেলা এলাকা, বাণিজ্যমেলা, মহাখালী, গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কাঁচপুর ব্রিজ, উত্তরা, আবদুল্লাহপুর ও কুড়িল বিশ্বরোড। সূত্রমতে, জামায়াত-শিবিরের হরতাল উপলক্ষে বিশৃঙ্খলা রোধ করতে বিশেষ ধরনের অস্ত্র ও গুলি দেয়া হয়েছে। এটি বিশেষ ধরনের ছররা গুলি। এটি শরীরে বিদ্ধ হলে ঘটনাস্থলেই কাবু হয়ে পড়বে। তবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা কম। এছাড়া, একটি ফায়ারে একাধিক ব্যক্তিকে টার্গেট করা সহজ। র‌্যাব, পুলিশ, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়াও বিশেষায়িত টিমকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে পুলিশের সোয়াত টিম কিংবা বিজিবি সদস্যদের তলব করা হতে পারে বলে সূত্র জানায়। পুলিশের ফুট পেট্রোল, মোবাইল পেট্রোল, টহল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া ঠাণ্ডা ও গরম জলকামান, আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি), প্রিজন ভ্যান ও এম্বুলেন্স টিমকে মাঠে নামানো হয়েছে। এদিকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় ৫ হাজার ফোর্স নামানো হয়েছে। রাত থেকেই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, কেবল পুলিশ আক্রান্ত হলেই গুলি ছোড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে এটি পুলিশের আইনগত অধিকার। নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তার স্বার্থেই অপরাধীদের দমন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দারা জানান, হরতালের পিকেটিং বন্ধ করতে রাজধানীর সকল প্রবেশপথে মধ্য রাত থেকেই পর্যাপ্ত সংখ্যক দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, আবদুল্লাহপুর, কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত-শিবির এবং বিরোধী দলের বিভিন্ন আস্তানায় সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এসব এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মীকে। গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে সারা দেশের বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের কার্যালয়। তল্লাশি চালানো হয়েছে বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও মেসে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, সেমসাইড এড়ানোর জন্য সরকার দলীয় সংগঠনের নেতাকর্মীদের পুলিশের পাশে থাকতে বলা হয়েছে- যাতে তারা ভুল টার্গেটের শিকার না হয়। এছাড়া, আরও কিছু কৌশল বাতলে দেয়া হয়েছে উভয় পক্ষকে।
জামায়াতের মিছিল বের হলে জবাবদিহি করতে হবে: হরতালে জামায়াত-শিবির যাতে কোন ধরনের মিছিল-পিকেটিং করতে না পারে নেতাকর্মীদের সে নির্দেশনা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল নগর আওয়ামী লীগের এক বর্ধিত সভা থেকে বলা হয়েছে, ঢাকার যেসব এলাকায় জামায়াত-শিবির মিছিল বা পিকেটিং করবে সে সব এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাদের জবাবদিহি করতে হবে। বর্ধিত সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, সাধারণ মানুষ যাতে ধরা না পড়ে সেদিকে খেয়াল রেখে পরজীবী জামায়াত-শিবিরকে সর্বাত্মক মোকাবিলা করতে হবে। জামায়াত- শিবিরকে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।
সভায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হলে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির কবর রচনা হবে। জামায়াতের দোসর বিএনপির রাজনীতি দুর্বল হয়ে যাবে, তাদের রাজনীতি করার কিছু থাকবে না। এজন্যই বিএনপি যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সঙ্গে মাঠে নেমেছে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মরণকামড় দিচ্ছে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নেতা-কর্মীদের জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, এখনও সময় আছে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ছাড়ুন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সরকারকে সহায়তা করুন।
সভায় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ওরা (জামায়াত-শিবির) বের হয় কোত্থেকে খবর নিন। আর না হলে যে ওয়ার্ড থেকে জামায়াতের মিছিল বের হবে সে ওয়ার্ডকে জবাবদিহি করতে হবে। তারা তো আর আসমান থেকে পড়ে না। নিশ্চয়ই কোন না কোন ওয়ার্ড-পাড়া থেকে আসে। শুধু দায়িত্ব নিয়ে বসে থাকলে হবে না- এদের খুঁজে বের করতে হবে।
মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, খুব দ্রুতই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করা হবে। এজন্যই জামায়াত-শিবির যত দিন যাবে আরও হিংস্র হয়ে উঠবে। এদের বিরুদ্ধে এখনই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আর সুযোগ দেয়া যাবে না।
মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এমএ আজিজ দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, প্রতিটি এলাকার অলিতে গলিতে খবর নিন জামায়াতের আস্তানা কোথায়? কারা তাদের অর্থ সরবরাহ করে তাদের খুঁজে বের করুন। তিনি বলেন, ওরা কিছু করতে পারলে আমাদের কাউকেই ছাড়বে না। তাই এখনই হামলা করে তাদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করতে হবে।
৩রা ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভাকে সফল করতে এবং জামায়াত-শিবিরের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এই বর্ধিত সভার আয়োজন করা হয়। সভায় নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এমএ আজিজ সভাপতিত্ব করেন।
জামায়াতের হরতালে সমর্থন বিএনপির: জামায়াতের ইসলামীর ডাকা হরতালে সমর্থন দিয়েছে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। দলের সমন্বয়ক তরিকুল ইসলামের পক্ষে দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ সমর্থনের বিষয়টি গণমাধ্যমকে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন, বুধবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একটি পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ ছিল। সমাবেশটি বানচাল করার জন্যই পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। সরকারের এ অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামী আজ রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে অর্ধদিবস এবং সারাদেশে পূর্ণ দিবস হরতাল ডেকেছে। সরকারের একটি অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে জামায়াত এ হরতাল ডাকায় বাংলাদেশ জাতীয়বাদাী দল হরতালে সমর্থন জানাচ্ছে। এদিকে দলীয় সূত্র জানায়, হরতালে সমর্থন দিলেও রাজপথে থাকবে না বিএনপি।
রাজধানীতে ৪০ হাজার পটকা উদ্ধার, গ্রেপ্তার ২: রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় ৪০ হাজার পিস পটকা উদ্ধার সহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে সাইফুল ইসলাম (৩০) ও তার গাড়িচালক আনোয়ার হোসেন (৪২)। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট থেকে এগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, রাজধানীতে আতঙ্ক ছড়াতে এসব পটকা ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছিল দুষ্কৃতকারীরা। তবে গ্রেপ্তারকৃত দুই ব্যক্তি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, উদ্ধার করা পটকাগুলো আতশবাজির কাজে ব্যবহারযোগ্য। এগুলো বিক্রির জন্য পুরান ঢাকায় নেয়া হচ্ছিল। শেরেবাংলা নগর থানার ওসি আবদুল মোমিন বলেন, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে মিরপুর-১ নম্বর থেকে রোকেয়া সরণি দিয়ে একটি পিকআপ ভ্যান ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছিল। পিকআপ ভ্যানটি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেটের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশের সন্দেহ হয়। তারা পিকআপ ভ্যানটি থামিয়ে তল্লাশি করলে এতে ৪০ হাজার পটকা ও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৫০১ পিস বারুদ (ফায়ার ওয়ার্কস) দেখতে পায়। পটকাগুলো মিরপুর-১ নম্বর গোলচক্কর থেকে জনৈক রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে আনা হচ্ছিল। ঘটনার পর পটকার বাহক সাইফুল ইসলাম ও পিকআপ ভ্যানের চালক আনোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর ফিরোজের দোকানে ওই পটকাগুলো পৌঁছে দেয়ার কথা ছিল। একটি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির মাধ্যমে যশোর সীমান্ত এলাকা থেকে তা ঢাকায় আনা হয়। এগুলো ভারতের তৈরী। ওসি মোমিন আরও বলেন, উদ্ধারকৃত বিস্ফোরকের মূল্য প্রায় ৮ লাখ টাকা। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক উপাদানাবলী আইন ১৯০৮-এর ৪ (খ/৫/৬) ধারা অনুযায়ী এএসআই আবু জাফর বাদী হয়ে মামলা করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.