রাজস্ব ফাঁকি ঠেকাতে ॥ অবৈধ ব্যবসা বন্ধে উন্মুক্ত হচ্ছে ভিওআইপি- সারাদেশে হাজারেরও বেশি লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে by ফিরোজ মান্না

 অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধ করার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ভিওআইপি লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। এই খাতে সারাদেশে এক হাজারের বেশি লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরে অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্য করে বহু প্রভাবশালী আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। তাঁরা যেন আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়ে টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন। তাঁদের হাতে প্রতিদিন হাওয়ায় আসছে কোটি কোটি টাকা। এতে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির পাল্লায় পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে ভিওআইপিকে উন্মুক্ত করা হচ্ছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী সাহারা খাতুন জনকণ্ঠকে জানান, অবৈধ ভিওআইপি বন্ধ করার জন্য বৈধভাবে লাইসেন্স দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আপাতত আমরা এক হাজার ৪টি লাইসেন্স ইস্যু করছি। পরবর্তীতে আরও কিছু লাইসেন্স দেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, এক হাজার লাইসেন্স দিলেই যে ভিওআইপি বন্ধ হবে এমন কথা নয়, তবে চেষ্টা করলে সফল হওয়া যায়। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে অবৈধ ভিওআইপির পরিমাণ অনেক কমেছে। বিটিআরসি অবৈধ ভিওআইপি বন্ধের জন্য অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিটিআরসির মাধ্যমে গত বছরের গোড়ার দিকে আবেদনপত্র আহ্বান করা হয়। প্রথম দফায় আবেদনপত্র অনেক কম পড়ায় আরও এক মাস সময় বাড়ানো হয়। তিন মাসে মাত্র এক হাজার ৬শ’ আবেদপত্র জমা পড়ে বিটিআরসিতে। বিটিআরসি আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে এক হাজার ৪টি আবেদনপত্র গ্রহণযোগ্য মনে করে। তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করে- একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যাচাই-বাছাইয়ে যতগুলো আবেদনপত্র যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে তার সব লাইসেন্স দেয়ার। গত সোমবার থেকে ভিওআইপি লাইসেন্স প্রাপ্তদের কাছে বিটিআরসি চিঠি পাঠানো শুরু করেছে। চিঠিতে বলা হয়েছে ৩০ দিনের মধ্যে লাইসেন্সের জামানত ফি ৫ লাখ টাকা জমা দিতে। যারা ৩০ দিনের মধ্যে জামানত ফি জমা দিতে পারবে না-তাদের লাইসেন্সপ্রাপ্তির চিঠি বাতিল করা হবে।
বিটিআরসির এক কর্মকর্তা বলেন, কেন কিভাবে ভিওআইপি ব্যবসা হচ্ছে তার জন্য ২০১১ সালের ডিসেম্বরে অবৈধ ভিওআইপি বন্ধের জন্য একটি শক্তিশালী ‘অবৈধ ভিওআইপি অনুসন্ধান’ নামে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি দীর্ঘ তিন মাস বিটিসিএল ও টেলিটকে তদন্ত শেষে ১৩ কারণ খুঁজে পেয়েছিল। পরে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয়, অবৈধ ভিওআইপি বন্ধের জন্য লাইসেন্স দিয়ে এটাকে বৈধ করাই ভাল। লাইসেন্সের ক্ষেত্রে কঠিন শর্ত জুড়ে দিলে আর কেউ অবৈধ ভিওআইপি করার সাহস পাবে না। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এখন ভিওআইপি লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে।
কমিটি পরবর্তীতে এই কারণগুলোই সুপারিশ আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তদন্ত কমিটি বলেছে, পূর্ণাঙ্গ ইন্টার কানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স), অত্যাধুনিক সফটওয়ার, রেডিও লিঙ্ক ব্যবহার, কল লিস্ট মুছে ফেলাসহ মোট ১৩ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে অবৈধ ভিওআইপি হচ্ছে। এগুলো বন্ধ হলে অবৈধ ভিওআইপি বহু গুণে কমে যাবে। গত বছরের এই সময়েও প্রতিদিন বৈধ পথে সাড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৬ কোটি মিনিট আন্তর্জাতিক কল দেশে আসত। বর্তমানে তা ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি মিনিটে দাঁড়িয়েছে। বাকি প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মিনিট কল অবৈধ পথে যাচ্ছে। এই কল থেকে সরকার কোন রাজস্ব পাচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট চক্র অনেকদিন ধরেই ওই ব্যবসা করে আসছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল আর টেলিটক এখন ভিওআইপি ব্যবসার নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) বন্ধের জন্য সরকার ৩ হাজারের বেশি ভিওআইপি লাইসেন্স দিতে পারে। বিটিআরসি ভিওআইপি লাইসেন্সের গাইডলাইন তৈরি করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। মন্ত্রণালয় বিটিআরসির পাঠানো গাইডলাইন পর্যালোচনা করে এ মাসেই লাইসেন্স দেয়ার অনুমতি দিতে পারে। ভিওআইপি লাইসেন্স উন্মুক্ত হলে অবৈধ কল কমে যাবে। অবৈধ ভিওআইপির কারণে প্রতি বছর সরকার প্রায় এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। ভিওআইপি বৈধ করলে এই টাকা সরকারের ঘরে আসবে।
অবৈধ ভিওআইপি কল বন্ধ করতে টেলিযোগাযোগের বিভিন্ন খাতে ভিওআইপি লাইসেন্স দেয়া হবে। লাইসেন্স সংখ্যা বাড়ালে প্রতিযোগিতামূলকভাবে লাইসেন্সধারীরা কল বাড়াবে। এক সময় বিদেশী কল আদান প্রদান হতো প্রতিদিন সাড়ে ৫ থেকে ৬ কোটি মিনিটি। এর মধ্যে দুই থেকে আড়াই কোটি মিনিট কল অবৈধ পথে চলে যায়। সরকার মনে করছে লাইসেন্স বাড়ালে রাজস্বও বাড়বে। ভিওআইপি লাইসেন্সের গাইডলাইন তৈরি করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেলেই লাইসেন্স দেয়ার কাজ শুরু হবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এতে কোন লাভ হবে না। অবৈধ ভিওআইপি চলতেই থাকবে। ভিওআইপি একটি প্রযুক্তি এবং সেটিকে মোকাবেলা করতে হবে প্রযুক্তি দিয়ে। বিভিন্ন মোবাইল অপারেটররাও ভিওআইপি করছে। আবার কেউ কেউ ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ কিনে রেডিও লিঙ্কের মাধ্যমেও ভিওআইপি চালিয়ে যাচ্ছে। এই ব্যবসা প্রভাবশালী মহলের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রভাবশালীদের হাত থেকে ভিওআইপি সরাতে হলে বিটিআরসির ভিওআইপি লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক বলে মনে করছেন। তখন আর এককভাবে প্রভাবশালীরা এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। আইজিডব্লিউয়ের (ইন্টারনেট গেটওয়ে) মাধ্যমে কল নিতে হবে। অন্যপথে কল নেয়ার কোন সুযোগ থাকবে না।

No comments

Powered by Blogger.