গ্রামীণ ব্যাংকের ঘাড়ে 'পারিবারিক' চুক্তি!

গ্রামীণ ব্যাংককে চট্টগ্রামের একটি প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল ২০ বছর আগে। এর মাধ্যমে গরিবের ব্যাংকটি এমন এক দায়িত্ব নেয়, যার সঙ্গে এর মূল কর্মকাণ্ডের কোনো সম্পর্কই নেই।
মূল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের চুক্তি এবং এর আওতায় ঋণ দেওয়া আইনসম্মত হয়নি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। খবর বিডিনিউজের।
গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে ওই ব্যবস্থাপনা দায়িত্বের চুক্তিতে সই করেছিলেন এর প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চুক্তিতে গ্রামীণ ব্যাংককে মালিকানা ছাড়া প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠানটি চালানোর বাকি সব ক্ষমতাই দেওয়া হয়। চুক্তিতে প্যাকেজেস করপোরেশন নামের প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সই করেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বাবা দুলা মিয়া সওদাগর। চুক্তিতে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর দেন ইউনূসের তিন ভাই মুহাম্মদ ইব্রাহীম, মুহাম্মদ আজম ও মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
১৯৬১ সালে পাকিস্তান প্যাকেজেস করপোরেশন নামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির মালিক ছিলেন দুলা মিয়া ও তাঁর ছেলেরা। বিভিন্ন নথি থেকে জানা গেছে, ওই পরিবার এখনো প্রতিষ্ঠানটির মালিক। শেয়ারহোল্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা বোর্ডে মুহাম্মদ ইউনূস এখনো আছেন।
গ্রামীণ ব্যাংক ও প্যাকেজেস করপোরেশনের মধ্যে ১৫ বছরের জন্য ব্যবস্থাপনা চুক্তিটি হয় ১৯৯০ সালের ১৭ জুন। ১৯৯৭ সালে প্যাকেজেস করপোরেশনের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ সামগ্রীকে। এ বিষয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরজাহান বেগম জানান, ওই হস্তান্তর প্যাকেজেস করপোরেশনের মালিকদের সম্মতিতে হয়েছিল।
১৯৯০ সালের চুক্তি অনুযায়ী প্যাকেজেস করপোরেশনে ইউনূসের �মুনাফার জন্য নয়� এমন প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কর্মীদের �প্রেষণে� নিয়োগেরও অনুমতি ছিল, যা তাঁদের পারিবারিক ব্যবসার জন্য লাভজনক। গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ছয়জন ব্যবস্থাপক বা নির্বাহী প্রেষণে গেছেন। প্যাকেজেস করপোরেশনে গ্রামীণ ব্যাংকের বিনিয়োগের
সুযোগও রাখা হয় ১৯৯০ সালের চুক্তিতে। চুক্তি অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের বিনিয়োগ বিবেচ্য হবে ওই ব্যবসায় ব্যাংকটির দেওয়া ঋণ হিসেবে।
গ্রামীণ ব্যাংক গত সোমবার জানায়, প্যাকেজেস করপোরেশনকে গ্রামীণ ব্যাংক যে ঋণ দিয়েছে, তা দেওয়া হয় ব্যাংকের এসভিসিএফ (সোশ্যাল ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড) থেকে। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এসভিসিএফ থেকে দেওয়া ঋণের পরিমাণ দুই কোটি ৯৯ লাখ ১০ হাজার ৮৬ টাকা। প্যাকেজেস করপোরেশনকে ১৭ বছর ধরে ঋণ দিয়েছে গ্রামীণ ফান্ড। তবে ১৯৯৩ সালের পর কত টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা জানায়নি গ্রামীণ ব্যাংক।
প্যাকেজেস করপোরেশনের �উৎপাদন বৃদ্ধি ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড গতিশীল� করতে গ্রামীণ ব্যাংক নতুন কর্মী নিয়োগেরও অধিকার পায় চুক্তিতে। তবে চুক্তি শেষে ওই কর্মীদের চাকরিতে বহাল রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না ইউনূসের পারিবারিক ওই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের। চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, চুক্তির ফলে প্যাকেজেস করপোরেশনের মালিকানায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। মুহাম্মদ ইউনূসের বাবা দুলা মিয়ার মৃত্যুর পর মুহাম্মদ আইয়ুব প্যাকেজেস করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন।
১৯৯০ সালের চুক্তিতে এইচ আই লতিফী নামের এক ব্যক্তিকে সালিস কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। লতিফী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তখনকার সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর চার বছর পর লতিফী গ্রামীণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। গ্রামীণ ট্রাস্ট গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ১৬ বছর ধরে গ্রামীণ ট্রাস্টের প্রধান হিসেবে আছেন লতিফী।
চুক্তি অনুযায়ী ব্যবসায় লাভ-লোকসান গ্রামীণ ব্যাংক ও প্যাকেজেস করপোরেশনের সমানভাবে (৫০:৫০) ভাগ করে নেওয়ার কথা। তবে লোকসানের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষই নগদ অর্থ দেবে না। লোকসান হলে তা পরবর্তী বছরের লাভের হিসাব থেকে মিলিয়ে নেওয়ার কথা।

গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পাওয়া আয় অনুদান
১৯৯০ সালের চুক্তি অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রয়োজনীয় মুদ্রণ কাজের বিনিময়ে প্যাকেজেস করপোরেশন যে লাভ করবে তা গ্রামীণ ট্রাস্টের তহবিলে যাওয়ার কথা। তবে গ্রামীণ ব্যাংক গত সোমবার জানায়, গত ২০ বছরে গ্রামীণ ট্রাস্টে কোনো অর্থ দেওয়া হয়নি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, যেহেতু প্যাকেজেস করপোরেশন লাভে যেতে পারেনি, তাই এ পর্যন্ত মুনাফা বণ্টনের প্রশ্ন ওঠেনি এবং গ্রামীণ ট্রাস্টের কোনো অনুদান পাওয়ারও সুযোগ হয়নি।
২০০৯ সালে প্যাকেজেস করপোরেশনের পুঞ্জীভূত মুনাফা ছিল ২৪ লাখ টাকা। ২০০৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৩৭ লাখ টাকা। গ্রামীণ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্যাকেজেস করপোরেশন ১৯৯৮ সাল থেকেই মুনাফা করছে। ২০০০ ও ২০০২ সালে এর লোকসান হয়। গ্রামীণ ব্যাংক দাবি করেছে, ২০০৯ সালে প্যাকেজেসের পুঞ্জীভূত লোকসান ছিল এক কোটি ৪০ লাখ টাকা।

�চুক্তি ও ঋণ দেওয়া আইনসম্মত হয়নি�
মূল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের চুক্তি এবং এর আওতায় ঋণ দেওয়া আইনসম্মত হয়নি বলে মনে করেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। অন্যদিকে সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের অভিযোগ, ওই চুক্তি ব্যক্তিস্বার্থে করা হয়েছে।
মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, �গ্রামীণ ব্যাংক দরিদ্র জনগণের জন্য ক্ষুদ্রঋণ দেবে। কোনো পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করাটা নৈতিক ছিল না। এটা আইনসম্মতও নয়।� ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের এই সদস্য পুরো বিষয়টিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপহীনতারও সমালোচনা করেন।
ফয়েজ আহমেদ বলেন, �এটা (চুক্তি) ব্যক্তিস্বার্থে করা হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস নিঃস্বার্থভাবে কখনোই কিছু করেননি। যা কিছু করেছেন, নিজের স্বার্থেই করেছেন।� ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমসহ ইউনূসের অন্যান্য কার্যক্রমের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরো বলেন, �তাঁর অন্যান্য কর্মকাণ্ডকে ন্যায্যভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত।�

No comments

Powered by Blogger.