অ্যাসিড সন্ত্রাসঃ ৯২ শতাংশ আসামিই ধরাছোঁয়ার বাইরে! by জাকিয়া আহমেদ

দেশে একের পর এক অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেই চলেছে। নারীর প্রতি এ সহিংসতা কঠিন আইন করেও কমানো যাচ্ছে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাব অনুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে ২০১২-এর অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ৭শ ৭৯টি মামলা হয়। এতে আসামি করা হয়, ৪ হাজার ৫শ ৬৭ জনকে। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এর বিপরীতে মাত্র ৫শ ৫৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। অর্থাৎ মাত্র  ৮ দশমিক ২৪ শতাংশ গ্রেফতার হয়েছে। বাকি ৯১ দশমিক ৭৬ শতাংশ আসামিই পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
আইনের এরকম দুর্বল প্রয়োগে নিশ্চয়ই এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। এ চিত্রের উন্নতি তো বহুদূরের ব্যাপার! একইসঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীরই চরম উদাসীনতাই ফুটে ওঠে।

দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, গত ১৫ জানুয়ারি বিয়েতে রাজি না হওয়ায় অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হন শারমিন আখতার আঁখি নামের ইডেন কলেজের এক ছাত্রী।

তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর পর অ্যাসিড নিক্ষেপ করে সন্ত্রাসীরা। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন দায়িত্বরত চিকিৎসকরা।

ঢামেকের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. হরিদাস সাহা প্রতাপ বাংলানিউজকে বলেন, “আঁখির শরীরের ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ অ্যাসিড দগ্ধ হয়েছে। এ ধরনের অ্যাসিড দগ্ধ অবস্থাকে ‘ডিপ বার্ন’ বলা হয়।”

বেশ কিছুদিন আগেও শুধুমাত্র প্রেমের জন্য নারীরা অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাসিড সন্ত্রাসের কারণ নানাভাবে বদলেছে। শুধু প্রেম নয়, বিয়ে, জমি, যৌতুক, পারিবারিক বিরোধের জের ধরে এখন নারী, পুরুষ এবং শিশুরাও অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন।

২০০২ সালের আগ পর্যন্ত অ্যাসিড সন্ত্রাসের জন্য নিজস্ব কোনো আইন ছিল না। অ্যাসিড আক্রান্তদের বিচার হতো প্রচলিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে।

কিন্তু ২০০২ সালে আলাদা করে আইন প্রণয়ন করা হয়। অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২ এবং অ্যাসিড অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২ প্রণয়ন করা হয়।

বর্তমানে অ্যাসিড সন্ত্রাসের জন্য যে সব মামলা বিচারাধীন রয়েছে, সেগুলো চলছে অ্যাসিড অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২-এর অধীনে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০২ সাল থেকে ২০১২-এর অক্টোবর পর্যন্ত এসিড সন্ত্রাস আইনে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৭শ ৭৯টি। ১ হাজার ৭শ ৬১টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে।

এর মধ্যে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৬৬টি মামলায়। আর ২০১২-এর অক্টোবর পর্যন্ত তদন্ত চলছিল ১৮টি মামলার।

অক্টোবর ২০১২ পর্যন্ত অ্যাসিড অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২-এর আওতায় নিষ্পত্তি হয়েছে ৬শ ৫৮টি মামলার। আর বিচারাধীন রয়েছে ৪শ ৮টি মামলা।

স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে আরও জানা যায়, এ পর্যন্ত ১শ ৭০টি মামলায় মোট ২শ ৮৪ জন লোকের সাজা হয়েছে। ৪শ ৮৮টি মামলা থেকে ১ হাজার ৬শ ২৯ জন খালাস পেয়েছেন।

সাজা পাওয়া ২শ ৮৪ জনের মধ্যে ১৩ জনের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। ১০২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১৬৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে।

অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্য থেকে জানা যায়, ২০০২-এ ৫৩ জন, ২০০৩-এ ৯৬ জন, ২০০৪-এ ৫০ জন, ২০০৫-এ ৬২ জন, ২০০৬-এ ৫৮ জন, ২০০৭-এ ৪৮ জন, ২০০৮-এ ৩২ জন, ২০০৯-এ ১৫ জন, ২০১০-এ ৭ জনের সাজা হয় অ্যাসিড অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আইনে।

অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে যৌতুকের জন্য ৮ জন নারী, পারিবারিক বিরোধের জন্য ২ জন পুরুষ ও ১০ জন নারী, ভূমি, সম্পত্তি এবং টাকা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে ৮ জন পুরুষ এবং ১৪ জন নারী, বিয়ে সংক্রান্ত বিরোধের জন্য ৫ জন নারী এবং ১ জন শিশু, প্রেম, বিয়ে এবং যৌন সংক্রান্ত বিরোধের জন্য ৩ জন পুরুষ, ৫ জন নারী এবং ১৪ জন শিশু এবং অন্যান্য কারণে ২১ জন অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় সূত্র জানায়, ২০১২-এর অক্টোবর পর্যন্ত তাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী অ্যাসিড আক্রান্ত নারীর সংখ্যা ২শ ১৪ জন, পুরুষ ৮১ জন এবং শিশুর সংখ্যা ৪৬ জন।

১৩ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে কত জনের সাজা কার্যকর হয়েছে, জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, “সাজা কার্যকর হয়েছে কিনা সেটা আসলে আমাদের জানা নেই। এ বিষয়ে আর ফলো আপও করা হয়নি। কেসগুলো তো এখন হাইকোর্টে আছে, সেখানে খোঁজ নেওয়া হয় না।”

তবে তিনি জানান, ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের মিটিংয়ে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের সভাপতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সহসভাপতি নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী।

জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল গঠিত হয়েছে পুলিশের মহাপরিদর্শক, বিভিন্ন এনজিও, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিত্বদের নিয়ে।

মিটিংয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে কমিটিকে অবহিত করার জন্য। তবে যেহেতু এটি একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া। তাই, কিছুটা সময় লাগবে।

No comments

Powered by Blogger.