শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের মহা-অবস্থান আজ-বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসাভাতা বৃদ্ধির ঘোষণা প্রত্যাখ্যান : ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত

অব্যাহত আন্দোলন ও শিক্ষক ধর্মঘট ঠেকাতে এমপিওভুক্ত শিক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসাভাতা বাড়িয়ে যথাক্রমে ৫০০ টাকা ও ৩০০ টাকা করেছে সরকার।
শিক্ষামন্ত্রী গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বর্ধিত এই ভাতা ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর করার ঘোষণা দেয়ার পরই সব শিক্ষক সংগঠন তা প্রত্যাখ্যান করেছে তাৎক্ষণিকভাবে। যদিও শিক্ষামন্ত্রী ওই সুবিধা বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘অতীতের কোনো সরকার শিক্ষকদের জন্য এত বেশি সুবিধা কখনো দেয়নি। শিক্ষকেরা কল্পনাও করতে পারেননি যে তাদের এত বেশি দেয়া হবে।’ উল্লেখ্য, শিক্ষামন্ত্রীর এ ঘোষণার আগে বাড়ি ভাড়া ১০০ টাকা ও চিকিৎসাভাতা ১৫০ টাকা দেয়া হতো।

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের একক বৃহৎ সংগঠন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট মন্ত্রীর ঘোষণার দুই ঘণ্টার মধ্যেই তা প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় প্রেস কাবের সামনে বিক্ষোভ করেছে। সংগঠনটি চাকরি জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে আজ বুধবার জাতীয় প্রেস কাবের সামনে শিক্ষকদের মহা-অবস্থান কর্মসূচি বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের নীতি-কর্মসূচির বড় সমর্থক শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যপরিষদ এবং প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় শিক-কর্মচারী ফ্রন্টও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ঘোষণাকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। শিক্ষক সংগঠনের নেতারা বলেছেন, মন্ত্রীর এ ঘোষণায় শিক্ষকেরা খুশি হতে পারেননি। এ ঘোষণা সম্মানজনক নয়। সরকারের ঘোষণায় শিক-কর্মচারীদের ােভের মাত্রা বহু গুণ বেড়ে গেছে। শিক্ষকদের ধর্মঘটসহ অন্য সব কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

এমপিওভুক্ত (মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ ও শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনরত সরকার সমর্থক ও বিরোধী দল সমর্থক সব শিক্ষক সংগঠন শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করলেও আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া দেশব্যাপী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষাকে শিক্ষক ধর্মঘটের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। শিক্ষক সংগঠনগুলো বলেছে, আসন্ন এসএসসি পরীক্ষার সময় শিক্ষকেরা সব ধরনের সহায়তা দেবেন পরীক্ষা গ্রহণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে।

বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি ঘোষণার পরপরই সব ক’টি শিক্ষক সংগঠন গতকাল বিকেলে পৃথকভাবে বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। চাকরি জাতীয়করণের এক দফা এবং শিক্ষাব্যবস্থা সরকারীকরণসহ ১৭ দফা দাবিতে সরকার সমর্থক ও বিরোধী দল সমর্থক শিক্ষক সংগঠনগুলো গত ১০ জানুয়ারি থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করে আসছে।

শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের ঢাকায় মহা-অবস্থান কর্মসূচি আজ : এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে আজ ঢাকায় জাতীয় প্রেস কাবের সামনে শিক্ষকদের মহা-অবস্থান ধর্মঘট পালিত হবে। সারা দেশ থেকেই শিক্ষক-কর্মচারীরা ঢাকায় জমায়েত হবেন। এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে সারা দেশ থেকেই শিক্ষক-কর্মচারীরা ঢাকায় পৌঁছতে শুরু করেছে বলে জানান জোটের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো: সেলিম ভূঁইয়া।

তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল : শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের ঢাকা মহানগর কমিটি মন্ত্রীর ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় প্রেস কাবের সামনে বিক্ষোভ করেছে। এতে জোটের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো: সেলিম ভূূঁইয়াসহ জোটের অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন ও বক্তব্য রাখেন। বিক্ষোভ মিছিল-পূর্ব সমাবেশে অধ্য মো: সেলিম ভূঁইয়া বলেন, বাড়ি ভাড়া ৪০০ টাকা ও চিকিৎসা ভাতা ১৫০ টাকা বৃদ্ধি করে আন্দোলন থামানো যাবে না। চাকরি জাতীয়করণ ছাড়া সাধারণ শিক-কর্মচারীদের আন্দোলন থামানো যাবে না।

জাতীয় শিক-কর্মচারী ফ্রন্ট : সরকারের নীতি-কর্মসূচির বড় সমর্থক ও প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় শিক-কর্মচারী ফ্রন্ট বলেছে, দুপুরে এক চা চামচ ভাত দিলে ুধার্ত ব্যক্তির যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে, শিক-কর্মচারীদেরও তাই হয়েছে শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণায়। মন্ত্রীর বক্তব্যে শিক-কর্মচারীদের আশা ভঙ্গ হয়েছে। ফ্রন্টের প্রস্তাব ও দাবিমতো সরকারি শিক-কর্মচারীদের মতো পূর্ণ চিকিৎসাভাতা, বর্তমান প্রচলিত স্কেলে ইনক্রিমেন্ট ও পূর্ণ উৎসবভাতা এবং স্কেলের শতাংশ হারে বাসা ভাড়া প্রদানে সরকার কার্যকর পদপে না নিয়ে শিা মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় শিক-কর্মচারীদের ােভের মাত্রা বহু গুণ বেড়ে গেছে। ফ্রন্টের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যপরিষদ : সরকার সমর্থক শিক্ষক সংগঠনগুলোর অন্যতম বৃহৎ জোট শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যপরিষদও শিক্ষকদের সুবিধা দেয়া ঘোষণাকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। পরিষদের অন্যতম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ মো: শাহজাহান আলম সাজু গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, মন্ত্রী ঘোষণায় শিক্ষকেরা খুশি হতে পারেননি। এ ঘোষণা শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক ও সহনীয়ও নয়। নেতারা বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর এ ঘোষণাকে তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছেন। শিক্ষাব্যবস্থা সরকারীকরণের দাবিসহ ১৭ দফা দাবিতে শিক্ষকদের ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। তবে এসএসসি পরীক্ষাকে ধর্মঘটের বাইরে রাখা হবে।

শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট (জ্যোতি গ্রুপ) : বিএনপি আমলের দলীয় এমপি ও দলের সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিতি নূর আফরোজ জ্যোতির নেতৃত্বাধীন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট (জ্যোতি গ্রুপ) শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে। জোটের মহাসচিব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর খান বলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা চাকরি জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে লাগাতার ধর্মঘট চালিয়ে আসছেন। এমপিওভুক্তদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে চাকরি জাতীয়করণের ইস্যু ধামাচাপা দেয়ার কৌশল বলে তিনি অভিযোগ করেন।

কলেজশিক্ষক সমিতি-অধ্যক্ষ পরিষদ : বাংলাদেশ কলেজশিক্ষক সমিতি (বাকশিস) ও বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ (বিপিসি) যথাক্রমে অধ্যক্ষ ইসহাক হোসেন ও অধ্যাপক ড. এ কে এম আবদুল্লাহ ও অধ্যক্ষ হারুন রশিদ পাঠান গতকাল এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর এ ঘোষণা শিক্ষকদের জন্য অসম্মানজনক।

শিক্ষামন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন : গতকাল দুপুরে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এমপিওভুক্ত বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসাভাতা বৃদ্ধির এবং তা ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর করার ঘোষণা দেন। ঘোষণায় বলা হয়, বিদ্যমান বাড়ি ভাড়া ১০০ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা ও চিকিৎসাভাতা ১৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের ভাতা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহকারী গ্রন্থাগারিকের পদ এমপিওভুক্ত করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ ঘোষণা দেয়ার সময় শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী নাহিদ বলেন, বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসাভাতার এ সুবিধা পাবেন বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার চার লাখ ৫৬ হাজার ৫৯০ জন, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৩ হাজার ২৫৪ জন শিক্ষক-কর্মচারী। একই সাথে ভাতা বৃদ্ধির সুবিধা পাবেন দেশের এক হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার ছয় হাজার ৭৬ জন শিক্ষক।

দীর্ঘ ২৮ বছর পর বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া ও চিকিসাভাতা বাড়ানো হলো। এতে সরকারের অতিরিক্ত ২৪৪ কোটি টাকা খরচ হবে।

সামরিক খাতে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার পর শিক্ষকদের জন্য মাত্র ২৪৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে এত বড় করে দেখা হচ্ছে কেন?Ñ জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কিছুটা বিব্রত অবস্থায় পড়ে বলেন, বিষয়টিকে এভাবে দেখলে সঠিক হবে না। মন্ত্রী শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের দাবির ব্যাপারে মন্তব্য করে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের পর এ ধরনের দাবি করা হচ্ছে। শিক্ষকদের একটি অংশ জাতীয়করণের দাবি করছে।

No comments

Powered by Blogger.