শেয়ারবাজারে চার মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন-বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাকে দুষছেন বিনিয়োগকারীরা

নতুন বছরেও অপ্রত্যাশিত দরপতনের ধাক্কা শেয়ারবাজারে। সদ্য বিদায়ী বছরের শেষভাগে এসে নীতি অস্থিরতায় বাজারে দরপতন ঘটলেও নতুন বছরে তার পুনরাবৃত্তির কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।
এমনকি শেয়ারবাজারে তারল্য সরবরাহকারী বা ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও দর পতনের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বলতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান দিতে না পারায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে। সেই হতাশা থেকে অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার কিনছেন না। আবার অনেকে নিজের পুঁজি বাঁচাতে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে একদিকে বাজারে ক্রেতা কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে বিক্রির চাপ। ফলে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে, যার পরিণতিতে শেয়ারের দাম কমছে।
সদ্য বিদায়ী বছরে মুদ্রাবাজারে হঠাৎ নগদ টাকার যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তা এখনো কাটেনি।
এ কারণে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) সর্বোচ্চ ১:১ দশমিক ৫ হারে গ্রাহকের ঋণসীমা বেঁধে দিলেও ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ওই হারে ঋণ দিতে পারছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউই ১:১ হারেও ঋণ দিতে পারছে না।
জানতে চাইলে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউর রহমান বলেন, 'বিদায়ী বছরের শেষে মুদ্রাবাজারে যে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছিল, সেটি এখনো কাটেনি। তারল্য সংকটেরই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শেয়ারবাজারে।' অচিরেই এই সংকট কেটে যাবে বলে তিনি আশাবাদী।
গভর্নরের সঙ্গে এসইসির বৈঠক : গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন এসইসির সদস্য ইয়াছীন আলী। ইয়াছীন আলী বৈঠকের সত্যতা স্বীকার করলেও এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, গভর্নর ও এসইসির সদস্যের মধ্যে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা চেয়েছে এসইসি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যেকোনো নীতি প্রণয়ন ও আদেশ জারির সময় পুঁজিবাজারের বিষয়টি যাতে বিবেচনায় নেওয়া হয়, সেই বিষয়েও গভর্নরের সহায়তা চাওয়া হয়। এ সময় গভর্নর যেকোনো নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে পুঁজিবাজারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার আশ্বাস দেন।
বাজার চিত্র : গতকাল মঙ্গলবার টানা দ্বিতীয় দিনের মতো দরপতন ঘটেছে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জে (ডিএসই)। ডিএসইতে লেনদেন হওয়া কম্পানিগুলোর মধ্যে গতকাল ৮৬ ভাগেরই মূল্য কমেছে। এর প্রভাবে ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক কমেছে প্রায় ২০৩ পয়েন্ট। নতুন বছরে এটি এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সূচকের পতন। এ নিয়ে দুই দিনে সাধারণ সূচক ৩২৪ পয়েন্ট কমেছে। একই সঙ্গে ডিএসইর লেনদেনের পরিমাণ গত চার মাসের মধ্যে গতকাল সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে এসেছে।
বাজারের এই পতনের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা, ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর অবস্থানকে দায়ী করেছেন। তাঁদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে ব্যাংকগুলো নিজেরাও বড় বিনিয়োগে আনতে পারছে না; গ্রাহকদেরও দিতে পারছে না বর্ধিত ঋণের সুবিধা।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুদ্রানীতি আতঙ্ক। ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ছয় মাসের জন্য নতুন যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে, তা নিয়েও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা রয়েছে।
গত সোমবারের মতো গতকালও সূচকের নিম্নগতি দিয়ে শুরু হয় ডিএসইর লেনদেন। প্রথম পাঁচ মিনিটেই সাধারণ সূচক প্রায় ৭০ পয়েন্ট কমে যায়। সকাল সোয়া ১১টা নাগাদ হারানো সূচক বেশ খানিকটা পুনরুদ্ধার হলেও বিক্রির চাপে শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থান ধরে রাখা যায়নি।
ডিএসইতে গতকাল ২৪৬ কম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়। এর মধ্যে ২২১টিরই দাম কমেছে, বেড়েছে মাত্র ২৯টির। দিনশেষে ঢাকার বাজারে এক হাজার ১৫৬ কোটি টাকার লেনদেন হয়, যা আগের দিনের চেয়ে ২১৫ কোটি টাকা কম। সেই সঙ্গে গতকালের লেনদেন গত চার মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে সর্বশেষ গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর ডিএসইতে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.