সিন্ডিকেটের কারসাজি চালের বাজারে-১৫ দিনে কেজিতে বেড়েছে ৭ টাকা, শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার আয়োজন by জিয়াউল হক মিজান

কৃত্রিম উপায়ে চালের দাম বাড়িয়ে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সঙ্ঘবদ্ধ এ চক্র কৌশলে সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে গত ১৫ দিনে চালের দাম কেজিপ্রতি ছয় থেকে সাত টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
বৃহত্তর বগুড়া ও দিনাজপুর অঞ্চলের কয়েকজন মিল মালিক এ সিন্ডিকেটের সাথে যুক্ত। কারসাজিতে যুক্তরা সরকারের কাছের লোক হওয়ায় সব কিছু জানাজানি হওয়ার পরও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। সরকারের এই নির্লিপ্ততার কারণে আগামী দিনগুলোতে কৃষি উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের শেষ নাগাদ বোরো ধান কাটার আগ পর্যন্ত এ সময়টায় চালের দাম বাড়তি রাখতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এই চক্র। এ সময়ের মধ্যে চালের দাম কেজিপ্রতি অন্তত ১০ টাকা বাড়িয়ে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সেরেই তারা মাঠে নেমেছে। তারা কৌশলে সরকারকে দিয়ে চাল রফতানির ধুয়া তুলেছে। পাইকারদের অভিযোগ, মিল মালিকেরা তাদের বাড়তি দামে চাল বিক্রি করতে বাধ্য করছেন। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতারা কেবল নির্ধারিত হারে কমিশন পাচ্ছেন।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি মেট্রিক টন চাল উৎপন্ন হয়। বাজারে বিক্রি হয় মাসে ১২ থেকে ১৫ লাখ মেট্্িরক টন। আগামী তিন মাসে চালের বর্ধিত মূল্য অব্যাহত রেখে ভোক্তাদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেবে চক্রটি। প্রথা অনুযায়ী, এর ভাগ পাবেন সংশ্লিষ্ট সমিতিগুলোর নেতা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং মন্ত্রণালয়-টিসিবিসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সংস্থার লোকজন। এ নিয়ে কথা বলার জন্য ভোক্তাদের পক্ষ থেকে শক্তিশালী কোনো প্লাটফর্ম না থাকা এবং সরকার নির্লিপ্ত থাকায় অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক, বর্গাচাষি, চালকলের মালিক এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আমন মওসুমে উৎপাদিত ধান কৃষকপর্যায়ে বিক্রি শেষে হয়ে গেছে ডিসেম্বরের মধ্যেই।  বেশির ভাগ কৃষকের হাতেই বর্তমানে আগামী বোরো ধান কাটার আগ পর্যন্ত নিজের খাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ধানের বেশি নেই। ধান চলে গেছে একশ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগীর হাতে। চাল কলের মালিক, গ্রাম্য সুদখোর মহাজন এবং বৃহৎ পুঁজির মালিক একশ্রেণীর মজুতদার কৃষক থেকে ধান কিনে তারপর নেমেছে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায়। বাড়তি সুবিধা নিয়ে একশ্রেণীর ব্যাংকার মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ দিয়েছেন এসব মজুতদারকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কম দামে কিনে নেয়া ধান রাখা হয়েছে সংশ্লিষ্ট কৃষকেরই গোলায়।

জানা গেছে, এবারের আমন মওসুমে প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকা। কিন্তু পাওনাদারদের দাবি মেটাতে বেশির ভাগ কৃষকই ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায় ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি খরচের পাশাপাশি দৈনন্দিন খরচ মেটাতে যারা অগ্রিম ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন তারা দাম পেয়েছেন আরো কম। ফলে নতুন করে ধান উৎপাদনের সব আগ্রহই তারা হারিয়ে ফেলছেন। অনেক কৃষক জমি অনাবাদি রেখে দিচ্ছেন। আর যারা বাধ্য হয়ে চাষ করছেন তাদের মধ্যে বিরাজ করছে নানামুখী আতঙ্ক। এক মাসের ব্যবধানে ধানের দাম বেড়েছে মণপ্রতি ১০০ টাকা পর্যন্ত। আর মোট চালের দামে ২৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। মাঝারি মানের চাল ৩৩ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকায়।

কৃষিকাজে উৎসাহ হারিয়ে ধান উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার উল্লাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হায়দার আলী বলেন, সার, বীজ, কীটনাশক, সেচ, হাল সব কিছুরই দাম বেশি। দাম কম শুধু ধানের। তিনি বলেন, কৃষকের যে দুর্দিন শুরু হয়েছে তাতে ২০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে হলে প্রতি বছর এক বিঘা করে জমি বিক্রি করতে হবে। এর পরও যে কৃষকের হাতে কোনো বিকল্প নেই তাকে তো লোকসান দিয়েই জমি চাষ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, যতই দিন যাচ্ছে ততই পুঁজির মালিকদের কাছে কৃষকেরা জিম্মি হয়ে যাচ্ছেন। টাকাওয়ালারাই এখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। দায়দেনার ভারে জর্জরিত কৃষকদের কাছ থেকে তারা নামমাত্র মূল্যে ধান কিনে নিচ্ছেন। কৃষকের গোলা শূন্য হওয়ার পর সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দিয়ে ভোক্তাদের গলা কাটা হচ্ছে। এসব মধ্যস্বত্বভোগী মজুতদারদের কারণে কৃষক ধান চাষে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারের উচিত নিজেদের ক্রয় বাড়িয়ে দিয়ে বাজারের ওপর কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। অন্যথায় দেশের কৃষিতে চরম মূল্য দিতে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
       

No comments

Powered by Blogger.