বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে শঙ্কা- সাবধান না হলে বিপর্যয়ে পড়বে বাংলাদেশ

গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও পূর্বাভাস ২০১৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, জ্বালানি সঙ্কট ও বিনিয়োগে খরার কারণে গত এক দশকের মধ্যে ২০১২ সালে সবচেয়ে মন্থরগতিতে এগিয়েছে দণি এশিয়ার অর্থনীতি।
এর পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যের বিক্রি কমায় গত বছর দণি এশিয়ার বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে এর মধ্যেও প্রবাসী আয়ের ওপর ভর করে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রেখেছে। দণি এশিয়ায় ২০১১ সালে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হওয়ার পর ২০১২ সালে গড় দেশজ উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। তবে ভারতের প্রভাবে এ অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি ২০১৩ সালে ৫ শতাংশ ও ২০১৪ সালে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়বে। আর বাংলাদেশ ২০১২ সালে ৬ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। জাতিসঙ্ঘের অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, দণি এশিয়ার কিছু অংশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাশঙ্কা অর্থনীতিতে সংশয় সৃষ্টি করেছে। বিশ্ব অর্থনীতির দুর্বলতা এবং আঞ্চলিক বা দেশীয় ঝুঁকির কারণেও দণি এশিয়ার অর্থনীতির সামনে কিছুটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে দেয়া পূর্বাভাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ অঞ্চলের ব্যাপারে বিশ্বসংস্থার প্রধান অর্থনৈতিক আশঙ্কা হলো রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে। দক্ষিণ এশিয়ার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ২০১৩ সালেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। ভারতে ২০১৪ সালের গোড়ার দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বাভাবিক সময় হলেও দেশটির অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, চলতি সালে ভারতে আগাম সাধারণ নির্বাচন হয়ে যেতে পারে। সরকারের বাইরে থাকা উত্তর প্রদেশের দু’টি আঞ্চলিক দলের ওপরই নির্ভর করছে মনমোহন সিং সরকারের আয়ু। তারা যেকোনো সুবিধাজনক সময়ে সমর্থন তুলে নিতে পারে। বলা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি বড় দেশেই ২০১৩ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে পাকিস্তানে মে মাসে সাধারণ নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনাকারী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোও সরকারি ও বিরোধী দল মিলে ঠিক করে ফেলেছে। ভারতে নির্বাচন অনুষ্ঠান কার অধীনে হবে তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। নির্বাচন নিয়ে যত সঙ্কট ও আশঙ্কা তা হলো বাংলাদেশকে ঘিরে। এখানে সরকারি দল চায় তাদের সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে আর বিরোধী দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলেছে। ফলে বাংলাদেশে নির্বাচন হবে কি না আর হলেও তা একতরফা নাকি সবার অংশগ্রহণে হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। আর এই অনিশ্চয়তা যে অর্থনীতির ওপর বড় আকারের প্রভাব ফেলবে তাতে সন্দেহ নেই। জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সঙ্কট ও বিনিয়োগ-খরাকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এর প্রতিটি সমস্যাই বাংলাদেশে তীব্রভাবে বিরাজমান। বাংলাদেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত পণ্য ও সেবাগুলোর অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে অসহনীয় হয়ে পড়ছে মূল্যস্ফীতি। এতে স্থির আয়ের মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। দুর্দশা বাড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের। এর পাশাপাশি বিদ্যুৎ-গ্যাস সমস্যার কোনো টেকসই সমাধান সরকার করতে পারছে না। এত দিন দুই টাকায় যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো, তা ১৮-২০ টাকায় পর্যন্ত কেনা হচ্ছে। এতে এক দিকে দুর্নীতি ও লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের জন্য; অন্য দিকে বিদ্যুতের দাম অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় জনভোগান্তি আর পণ্য উৎপাদনের খরচ বাড়ছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে। একই সাথে বিনিয়োগের ক্ষেত্রও হয়ে পড়ছে সঙ্কুচিত। এর মধ্যে রেমিট্যান্স অর্থনীতির গতি বজায় রাখতে যে ভূমিকা এত দিন রাখছিল, তা অব্যাহত থাকবে কি না, সেটা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

আমরা মনে করি, এ অবস্থায় রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকি নেয়ার কোনো সুযোগ সরকারের নেই। আগামী নির্বাচন কবে কার অধীনে হবে তা এখনই নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে গ্যাস-বিদ্যুৎ অবকাঠামোর মতো অর্থনৈতিক বিকাশের চাবিকাঠিকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক দুর্নীতি ও ওপর মহলের পয়সা বানানোর হাতিয়ারে পরিণত করা উচিত হবে না।

No comments

Powered by Blogger.