মহাজোট সরকারের ২ বছর-চমক নেই, আছে বিতর্ক by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য

আগামীকাল ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে। সরকারের সাফল্য তুলে ধরতে এখন সরকার ও দলে চলছে সর্বশেষ প্রস্তুতি।
তবে নানা ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় বছরে অনেক ভালো কাজ হলেও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে নানা কারণে। দিনবদলের স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করা সরকারের মন্ত্রিসভা চমক লাগানোর মতো কোনো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেনি দুই বছরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্রের মন্তব্য, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির বেপরোয়া আচরণের চরম মূল্য গোটা দলকে দিতে হয়েছিল পরবর্তী নির্বাচনে। ওই ঘটনা থেকে এবার দলটি শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এ ছাড়া গত বছর পাবনা ও নাটোরের সহিংস ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলকে বিপাকে পড়তে হয়। দুই বছরে এও প্রমাণিত হয়, সরকার নামেই মহাজোট।
বিতর্কে কয়েকজন এমপি : গত দুই বছরে বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য যেসব সংসদ সদস্যের নাম বারবার উচ্চারিত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন ভোলা-৩ আসনের এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, পটুয়াখালী-৩ আসনের গোলাম মাওলা রনি, কক্সবাজার-৪-এর আবদুর রহমান বদি, চট্টগ্রাম-১০ আসনের এম আবদুল লতিফ, ঢাকা-১৬ আসনের ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ, ময়মনসিংহ-১০ আসনের গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, যশোর-১-এর শেখ আফিল উদ্দিন এবং পাবনা-৫ আসনের গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স।
গত বছরের ১৩ আগস্ট নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের লাইসেন্স করা পিস্তলের গুলিতে রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম আহমেদের মৃত্যু নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অভিযোগ ওঠে, শাওনের গুলিতেই ইব্রাহিম খুন হন। তবে এরপর যুবলীগ তাদের নেতা শাওনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। গত বছরের জুনে আশুলিয়া বাজারসংলগ্ন সেতুর কাছে কর্তব্য পালনের সময় ইলিয়াস মোল্লাহ সাভারের ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. শরীফুল ইসলামকে মারধর করেন। যুবদল নেতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ায় শার্শা থানার ওসিকে মারধর করেন আফিল উদ্দিন। নিজ এলাকায় বিভিন্ন কারণে বারবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন আবদুর রহমান বদি ও গোলাম মাওলা রনি। ভূমি দখল, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের পেটানো, সরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনা, পুলিশ কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে দুজনের বিরুদ্ধে। আবদুল লতিফ বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের আধিপত্য নিয়ে লড়াইয়ে বিতর্কিত হয়েছেন।
পাশাপাশি দুই বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি সারাহ বেগম কবরী এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের মধ্যে বিবাদ লেগেই ছিল।
অনিয়ন্ত্রিত যুবলীগ, ছাত্রলীগ : প্রথম বছরের মতো দ্বিতীয় বছরেও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সরকার সমালোচিত হয়। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ছাত্রলীগের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকরের মৃত্যু। তবে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে অব্যাহত হুঁশিয়ারি উচ্চারণ ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি বন্ধ করতে পারেনি। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগের দায়িত্ব আওয়ামী লীগ নেবে না বলে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে মন্তব্য করা হয়। বিভিন্ন অপকর্মের জন্য ছাত্রলীগ ও যুবলীগের প্রায় দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে স্থায়ী এবং সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। কিন্ত পরিস্থিতি বদল হয়নি।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর পাবনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে পরীক্ষা ভণ্ডুলের পাশাপাশি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করে। এর জের ধরে পাবনার ডিসি-এসপিসহ জেলা প্রশাসনের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, পাবনার এই ঘটনার ইন্ধনদাতা ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স।
এরপর ৮ অক্টোবর নাটোরে বিএনপির একটি মিছিলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালালে নাটোরের বনপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নুর বাবু (৪০) নিহত হন। ভিডিও ফুটেজে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা চিহ্নিত হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মন্ত্রীদের নানা কথন : সরকারের শুরু থেকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের বিভিন্ন বেফাঁস মন্তব্যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় সরকারকে। বাজার দর নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, জঙ্গি ইস্যুতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, টিপাইমুখে বাঁধ ইস্যুতে পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী ব্যাপক সমালোচিত হন। অক্টোবরে সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী গোপালগঞ্জে এক আলোচনা সভায় বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ভবিষ্যতে যে ১৩ হাজার ৩৫০ জন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হবে, তাতে দলীয় লোকের বাইরে একজনকেও চাকরি দেওয়া হবে না। কোনো কর্মকর্তা এ সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিডিআর ঘটনা, খালেদা জিয়ার বাড়ির ব্যাপারে একেক মন্ত্রীর একেক কথা সরকারকে বিব্রত করেছে বারবার। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজের পদত্যাগও সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। সোহেল তাজ গত বছর প্রথম দফায় ১ জুন ও পরের দফায় ৩১ মে পদত্যাগ করেন বলে দাবি করেন। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে কিছুই খোলাসা করা হয়নি দীর্য় এক বছরে। পরে তাঁকে সরকারি গেজেট নটিফিকেশনের মাধ্যমে দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দেখানো হয়।
গত মাসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আবুল হোসেনের পদত্যাগ দাবি করেছেন খোদ সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্য।
নামেই মহাজোট : মহাজোট সরকার হলেও গত দুই বছরে সরকার পরিচালনায় জোটের শরিকদের কোনো রকম মূল্যায়ন করেনি জোটপ্রধান আওয়ামী লীগ। এই নিয়ে শরিকদের মধ্যে রয়েছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দুই বছরে মাত্র চারটি বৈঠক হয় এবং তা ছিল নিছক আনুষ্ঠানিকতা। সরকারের এক বছরের মাথায় গত বছরের ৫ জানুয়ারি হয় প্রথম বৈঠক। এরপর ৯ ফেব্রুয়ারি হয় দ্বিতীয় বৈঠক, ১ জুন গণভবনে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রথমবারের মতো মহাজোটভুক্ত দলগুলোর শরিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় একটি বৈঠক এবং সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর ১৪ দলের সর্বশেষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
এ ছাড়া আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের পৌর মেয়র পদে সমঝোতা হলেও অন্যদের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়নি। এদিকে আদালতের রায়ের পর এরশাদের বিচার দাবি করেছে জোটের শরিকরা। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ এখনো মুখ খোলেনি।
এদিকে দুই বছরের শাসনামলে মহাজোট সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপদেষ্টা ও আমলাদের মধ্যে বেড়েছে দূরত্ব। ফলে প্রশাসন কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকারে সিদ্ধান্ত পাচ্ছে না কাক্সিক্ষত গতি।
এ ছাড়া ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত, সবখানেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আওয়ামী লীগে। সহযোগী সংগঠনগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ কার্যত হারিয়ে ফেলেছে সংগঠনটি। এ ছাড়া সাংসদ এবং তৃণমূলের দ্বন্দ্বে তৃণমূলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির।
অভিযোগ রয়েছে, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। জেলা-উপজেলাগুলোয় সংগঠনের কার্যক্রম চলছে কিছু প্রভাবশালী নেতার সিদ্ধান্তে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই পার্টি অফিসগুলোর পরিবর্তে ভিড় বেড়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, মন্ত্রী ও এমপিদের বাসাবাড়িতে।

No comments

Powered by Blogger.