নিহত হয়েছে শ্বেতাঙ্গ অতএব আমরা ক্ষুব্ধ by রবার্ট ফিস্ক

যা তা ব্যাপার; তা নয় কি? আমাদের ‘আনুষঙ্গিক ক্ষতি’ ওদের ‘আনুষঙ্গিক ক্ষতি’ থেকে কতই না আলাদা। গতকাল আলজেরিয়ার একজন পুরনো বন্ধুর সাথে কথা হলো।
সে বিমান পরিবহন ব্যবসার লোক। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাদের দেশের সৈন্যরা যে একটি গ্যাস প্ল্যান্টে (জিম্মি উদ্ধারের জন্য) হামলা চালিয়েছে, সে ব্যাপারে তার কী প্রতিক্রিয়া? ফোনে চিৎকার দিয়ে সে বলল, ‘রবার্ট, চমৎকার অপারেশন। আমরা সন্ত্রাসবাদীদের ধ্বংস করে দিয়েছি।’

কিন্তু নির্দোষ জিম্মিদের কী হলো? তাদের যে মরতে হয়েছে। সে বন্ধুর জবাব, ‘ওরা হতভাগা। ’৯০-এর দশকে আমাদের দেশে যুদ্ধে হাজার হাজার নারী-শিশু মারা পড়েছে। সেটা ভয়ানক ট্র্যাজেডি। তবুও আমরা লড়ছি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে।’

হ্যাঁ, সেখানে এটাই ঘটছে। আমাদের লোকজন যে নিহত হলো, তা নিয়ে বন্ধুটির বিন্দুমাত্রও ভাবনা নেই। এর পেছনে অবশ্য যুক্তিও আছে। কারণ আজ আমরা (মানে, পাশ্চাত্য) ুব্ধ। নিরপরাধ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছে বলে নয়, আলজেরিয়ায় নিহত জিম্মিদের বেশির ভাগই সাদা চামড়া আর নীল চোখের মানুষ বলে আমাদের এই প্রতিক্রিয়া। যদি ‘পশ্চিমা’ সব জিম্মিকে উদ্ধার করা যেত এবং নিহত নিরপরাধ ব্যক্তিদের সবাই হতো আলজেরিয়ান, তা হলে এই অভিযান নিয়ে কোনো কথা উঠত না।

এই অভিযানে আলজেরিয়ার হেলিকপ্টার থেকে বোমা ফেলা হয়েছে। এতে নিহতদের সবাই আলজেরিয়ার মানুষ হলে, আমাদের মিডিয়ার হেডিং হতো সে দেশের সামরিক বাহিনীর সাহস ও নৈপুণ্যের ওপর। এর সাথে থাকত পাশ্চাত্যের সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর কৃতজ্ঞতার খবর।

এটাকে ‘বর্ণবাদ’ বলা হয় না। যখন জর্জ বুশ ও ব্লেয়ার ইরাকে পুরোদমে অভিযান চালিয়ে যুদ্ধাপরাধে মেতে উঠলেন, আমরা তখন ইরাকিদের অবস্থা নিয়ে একটুও ভাবিনি। সেখানে বছরে ১০ হাজার লোক মারা গেছে? ২০ হাজার? না কি জর্জ বুশের কথা মতো ‘৩০ হাজার, এর কম বেশি।’ আমাদের যারা নিহত হয়েছে, ওরা মূল্যবান। আমরা জানি, বুশ-ব্লেয়ারের হামলা শুরু হওয়ার পর ইরাকে চার হাজার ৪৮৬ জন মার্কিন সেনা যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে।

আপনারা জানেন, কাদের নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা, আর কাদের ব্যাপারে কোনো চিন্তাভাবনা নেই। আগামী কয়েকটা সপ্তাহে লক্ষ করবেন, আফ্রিকার মালিতে যুদ্ধরত ফরাসি সেনাদের ‘রোল অব অনার’ বাড়ছে। ফ্রান্সের পত্রপত্রিকায় তাদের আত্মীয়-পরিজনের সাক্ষাৎকার এবং আহতের পরিসংখ্যান দেখতে পাবেন। তবে নাইজেরিয়া কিংবা মালির যেসব সৈন্য একই অভিযানে নিহত হচ্ছে, ওদের খোঁজ নিতে গিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। কারণ তাদের আত্মত্যাগের কোনো বয়ান-বিবরণ থাকবে না।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেখলে, পুরো বিষয়টাকে বিশ্বের অন্যান্য অংশে আমাদের সম্পূর্ণ অযৌক্তিক হস্তক্ষেপের টিভিতে আবার চিত্রায়ণ বলেই মনে হয়। মালিতে ফরাসি সৈন্যরা নাকি মাত্র ‘কয়েক সপ্তাহ’ থাকবে। এটা বলেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওঁলাদে আর তার দোসরেরা। উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ সৈন্যরা প্রথম যখন হাজির হয়েছিল, তখন কি আমরা একই কথা বলিনি? অথচ সেসব সৈন্য সেখানে দশকের পর দশক অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ করেছে। ১৯৮২ সালে ইসরাইলিরা মার্চ করে লেবাননে ঢুকে এই কথাই বলেছে। অথচ ওরা লেবাননে ছিল এরপর ১৮টি বছর। আমরা আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করার সময় কি ঠিক একই কথা ভাবিনি? তখন তো আমরা এটাও ভেবেছি, আমাদের লোকজন দেখতে পাবে না যে, আমরা রাগের মাথায় একটা গুলিও ছুড়েছি।

পুরনো শয়তান বার্নার্ড কুচনার এ সপ্তাহে দাবি জানিয়ে বলেছেন, মালিতে ব্রিটিশ স্থলবাহিনী ইসলামি ‘সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে ফ্রান্সের লড়াইয়ে সহায়তা করতে হবে। তার চোখ দুটো একই সাথে উন্নাসিকতা ও দেশপ্রেমে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এটা ফরাসিদের একটা বৈশিষ্ট্য। ১৯১৪ সালে মালি দেশটি নিয়ে আঁতাতের ঘটনায় ফ্রান্স একই আচরণ করেছিল। কিন্তু আমরা অর্থাৎ পাশ্চাত্য, আজ মালিতে কেন? মাত্র দু’সপ্তাহ আগেও পাঠকদের ক’জন জানতেন মালির রাজধানীর নাম কী?

গতকাল আরেক বন্ধুকে ফোন করলাম। সে ফ্রান্সের সাবেক সৈন্য। জিজ্ঞেস করি, ‘ফ্রান্স মালিতে গেল কী কারণে?’ জবাব : ওরা বলছেÑ ‘ইসলামপন্থীরা (রাজধানী) বামাকো পৌঁছে যাবে; তা হলে কাবুলে তালেবানরা যা করেছিল, তেমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে; উগ্রপন্থীরা রাষ্ট্রটা নেবে দখল করে।’ তবে আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। মালি একটা কৃত্রিম রাষ্ট্র। এর উত্তরাঞ্চলের অধিবাসী, বিশেষ করে তুয়ারেগরা, দক্ষিণের কালোদের সরকারের অধীনে শাসিত হতে অস্বীকার করে এসেছে সব সময়ই। মালির ইস্যুটা ‘ইসলাম’-এর আবরণে আসলে গোত্রীয় ব্যাপার। এই হ-য-ব-র-ল থেকে আমরা কিভাবে নিজেদের বের করে আনব?’

আমাদের হয়তো উত্তর পেতে হবে (আলজেরিয়ার) মোখতার বেলমোখতার থেকে।

এই ভবঘুরেকে মনে করা হচ্ছে এবার জিম্মি করার ঘটনাটির নাটের গুরু। কথিত এই কিংবদন্তি ব্যক্তির কাছে ইসলামের প্রতি দায়িত্ব পালনের চেয়ে বেআইনি ও ভয়াবহ বিস্ফোরকের প্রতি আগ্রহটা বেশি। বেলমোখতার এবং কয়েকটা দেশে তার সিগারেট, অস্ত্র, মাদক, হীরা ও অবৈধ অভিবাসী ব্যবসায় সম্পর্কে উত্তর আফ্রিকার সাংবাদিকদের জানা আছে। সাংবাদিকেরা এ জন্য আতঙ্কিত যে, এখন বেলমোখতারের জন্মস্থান আলজেরিয়াও মালিতে পাশ্চাত্যের ক্রুসেডে জড়িয়ে পড়ছে। ফ্রান্সের যুদ্ধবিমান পাঠানোকে আলজেরিয়ার পত্রপত্রিকা তীব্র সমালোচনা করেছে। কিন্তু এ খবর লন্ডনের মিডিয়া এড়িয়ে গেছে। লন্ডনে আলজেরিয়ার মানুষের মতের চেয়ে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র গুরুত্ব বেশি। ফরাসি ভূমিকাকে আলজেরিয়ায় দেখা হচ্ছে এর উপনিবেশবাদী প্রাক্তন শাসকের হাতে নতুন করে লাঞ্ছনা হিসেবে। আমরা ইরাক-আফগানিস্তান ও ফিলিস্তিনে মুসলমানদের হত্যার বিষয়কে অবজ্ঞার চোখে দেখেছি। এখন আলজেরিয়ার মানুষ আমাদের নিহত ব্যক্তিদের দেখছে একই দৃষ্টিতে। সিরিয়ার ব্যাপারটা আমাদের জন্য ব্যতিক্রম। আমরা চাই, বাশার আল আসাদ ধ্বংস হোক। তাই তার বাহিনীর শিকার যারা, তাদের সবাই আমাদের কাছে মর্যাদাবান। তবে নৃশংস আসাদের মুখোমুখি যে বিদ্রোহীরা, তাদের সাথে বেলমোখতার ও তার দলবলের মতো ‘ইসলামপন্থী’ও আছে। এদের মতো লোকজন ফরাসি মন্ত্রী কুচনারের ক্রোধের কারণ।

আমি কি বর্তমান পরিস্থিতিতে ঔপনিবেশিক যুগের উন্মত্ততার ঘ্রাণ আবার পাচ্ছি? ফরাসি সৈন্যরা বিদ্রোহীদের মোকাবেলায় লড়ছে। আর ‘সন্ত্রাসবাদী’রা পিছু হটছে। ১৯৫৪ থেকে ’৬২ পর্যন্ত আলজেরিয়া সম্পর্কে এমন সংবাদ শিরোনাম থাকত প্রতিদিন। কসম খেয়ে বলছি, সে যুদ্ধে ফ্রান্স হেরে গিয়েছিল।

(দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ১৮ জানুয়ারি, ২০১৩)

লেখক : আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ভাষান্তরÑ মীযানুল করীম

No comments

Powered by Blogger.