ছাত্রলীগ থামছে না

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫ লাখ টাকার কাজের দরপত্র দাখিল নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে দুই দফা সংঘর্ষ হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিন ও বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন দুমকি বাজারের অর্ধশত দোকান।
এ ঘটনায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ীসহ অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন। ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ককটেল বিস্ফোরণে ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
দোকানপাট ভাঙচুর এবং দুমকি উপজেলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদসহ ১০ ব্যবসায়ীকে আহত করার প্রতিবাদে দুমকি বাজারে আজ বুধবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছেন ব্যবসায়ীরা।
আরেক ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতারা গত রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের একটি ছাত্রীনিবাসে ঢুকে ছাত্রীদের কক্ষ ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন। তাঁরা পরদিন রাতে হকিস্টিক নিয়ে ছাত্রীনিবাসে হামলা চালানোর চেষ্টা করেন। দারোয়ান গেট না খোলায় তাঁকে হকিস্টিক দিয়ে পেটানো হয়।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রদলের সংঘর্ষ ও গুলিবিনিময় হয়। দুই দিন পর শনিবার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে এক শিশু নিহত হয়। তিনজন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়। কাজ শেষ করার আগেই বিল পরিশোধের দাবি পূরণ না করায় গত রোববার সিলেট এমসি কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে ঢুকে উন্নয়নকাজে তদারকি করা প্রকৌশলীকে মারধর করে বের করে নিয়ে যান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর ১০ জানুয়ারি হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এসব ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোয় একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
পটুয়াখালী: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্থানীয় লোকজন জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগ থেকে ৪৫ লাখ টাকার সাতটি প্যাকেজে দরপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল গতকাল। ওই দরপত্র দাখিলকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সকাল থেকে প্রশাসনিক ভবনের আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন। বেলা ১১টার দিকে দুমকি থানা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও স্থানীয় ঠিকাদারেরা দরপত্র দাখিল করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকেন। মুখোমুখি হলে তাঁদের বাধা দেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বাগিবতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ। এ সময় বেশ কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
সংঘর্ষ চলাকালে ক্যানটিনে হামলা চালানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে ওই ক্যানটিন ইজারা নেন দুমকি থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুজ্জামানের বড় ভাই শাহীন।
প্রায় ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে উভয় পক্ষের কমপক্ষে ১৫ জন আহত হন। পরে পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্যরা ক্যাম্পাসে গেলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। দুমকি থানা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মী এবং স্থানীয় ঠিকাদারেরা ক্যাম্পাসের পূর্ব গেটের বাইরে অবস্থান নেন।
এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুল মোতালেব খান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দরপত্র দাখিলের প্রক্রিয়া স্থগিত করার কথা জানানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বেলা পৌনে তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই কর্মী ক্যাম্পাসের পূর্ব গেটের বাইরে দুমকি বাজারে গেলে তাঁদের মারধর করেন দুমকি থানা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ওই দুজনকে ‘সাধারণ’ ছাত্র উল্লেখ করে ক্যাম্পাসে আহত হওয়ার খবর ছড়ান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এই খবরে বিভিন্ন ছাত্রাবাস থেকে সাধারণ ছাত্ররা বেরিয়ে আসেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে দুমকি বাজারে গিয়ে অর্ধশত দোকানপাট ভাঙচুর করেন। এ সময় তাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন স্থানীয় ব্যবসায়ী ও থানা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে উভয় পক্ষের কমপক্ষে ৩৫ জন আহত হন।
আহত ছাত্রদের মধ্যে ১৯ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ কেয়ার সেন্টারে চিকিৎসা নিয়েছেন। অপর পক্ষের আহত দুমকির শ্রীরামপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ অন্যরা বিভিন্ন জায়গায় প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি কামরুজ্জামান বলেন, সংঘর্ষের জন্য দুমকি থানা ছাত্রলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা দায়ী। তারা জোর করে ক্যাম্পাসে ঢুকে হামলা চালিয়েছে এবং অন্যদের দরপত্র দাখিলে বাধা দিয়েছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে দুমকি থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা নিজেরাই সব কাজ ভাগবাটোয়ারা করে নিতে চেয়েছিলেন। স্থানীয় ঠিকাদারেরা দরপত্র দাখিল করতে গেলে তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়।
উপাচার্য মো. শামসুদ্দীন গত রাতে বলেন, ক্যাম্পাসে পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠক করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হামলা চালিয়ে দুমকি বাজারের কমপক্ষে অর্ধশত দোকানপাট ভাঙচুর করেছেন। আহত হয়েছেন সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদসহ কমপক্ষে ১০ জন ব্যবসায়ী। আবুল কালামকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের ওপর নির্মম হামলার বিচার, সুষ্ঠু তদন্ত ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে দুমকি বাজারে আজ সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
বরিশাল: শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীনিবাসের সাধারণ ছাত্রীদের অনেকে জানান, রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে কলেজের ছাত্রকল্যাণ পরিষদের (ছাত্রলীগের গঠন করা পরিষদ) সহসভাপতি (ভিপি) আবু তালেব মো. আবদুল্লাহ ও উপসহসভাপতি (প্রোভিপি) আবদুল্লাহ বাকি অনুমতি ছাড়াই ছাত্রীনিবাসে ঢোকেন। এ সময় তাঁরা তিনতলার বিশেষ কয়েকটি কক্ষে যেতে চান। একপর্যায়ে চারতলায় একটি কক্ষে ঢুকে ছাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন এবং কয়েকটি কক্ষ ছেড়ে দিতে ছাত্রীদের হুমকি দেন।
এর প্রতিবাদে সোমবার সকালে ক্লাস বর্জন করে অধ্যক্ষের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন এবং মানববন্ধন করেন সাধারণ ছাত্রীরা। দোষীদের শাস্তিসহ ১০ দফা দাবিতে কলেজ প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপিও দেন তাঁরা। প্রশাসন ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়।
সাধারণ ছাত্রীদের ভাষ্যমতে, সোমবার রাত ১০টার দিকে মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মো. হারুন অর রশীদ, ছাত্রকল্যাণ পরিষদের ভিপি ও প্রোভিপির নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হকিস্টিক নিয়ে ছাত্রীনিবাসে যান। কিন্তু ছাত্রীনিবাসের গেটে তালা থাকায় তাঁরা ভেতরে ঢুকতে পারেননি। এ কারণে তাঁরা দারোয়ানকে হকিস্টিক দিয়ে পেটান। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এর প্রতিবাদে সাধারণ ছাত্রীরা গতকাল সকালে ছাত্রীনিবাস প্রাঙ্গণে মিছিল করেন এবং ছাত্রীনিবাসের গেটে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগের দোষী নেতা-কর্মীদের বিচার দাবি করেন। একই সঙ্গে রাতে ছাত্রীনিবাসে ভিপি-প্রোভিপিকে আসতে সহযোগিতা করায় কলেজ ছাত্রলীগের সদস্য ও ছাত্রীনিবাসের সাধারণ সম্পাদক নূপুর পালকে ছাত্রীনিবাস থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানান।
অন্যদিকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে বিএনপি-শিবিরকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগের দাবি জানান এবং সকাল ১০টা থেকে অধ্যক্ষকে তাঁর কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখেন। একপর্যায়ে তালা দিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অশালীন স্লোগান দিতে থাকেন। একই দাবিতে তাঁরা ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
ভিপি আবু তালেব মো. আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন ছাত্রীনিবাসের ছাত্রলীগের নেত্রী ও ছাত্রীনিবাসের সাধারণ সম্পাদক নূপুর পাল সোমবার রাত ১০টায় সভা ডাকেন। কিন্তু এর আগেই আন্দোলনকারী ছাত্রীরা সভা করতে চান। নূপুর তাঁদের বারণ করলে তাঁকে অকথ্য গালাগাল করেন। এ কথা শোনার পর আমরা ছাত্রীনিবাসে যেতে চাই। কিন্তু গেটে তালা থাকায় ঢুকতে পারিনি। হামলার উদ্দেশ্যে যাইনি।’
বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র শওকত হোসেন কলেজ ক্যাম্পাসে বেলা পৌনে দুইটার দিকে যান। তিনি শিক্ষক, আন্দোলনরত ছাত্রী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির আশ্বাস দেন।
কলেজের অধ্যক্ষ মো. শহীদুল আলম বলেন, ঘটনা তদন্তে উপাধ্যক্ষ মাকছুমুল হককে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আগামী সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। এরপর দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.