মামলা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতেই কেটে গেল ৪ বছর-মামলা আদৌ হবে কি না জানেন না অভিযোগকারী; পুলিশ কর্মকর্তা ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ; সময়ক্ষেপণ কোনোভাবেই কাম্য নয় : বিশেষজ্ঞ অভিমত মো: শহীদুল্লাহ মিঞা

সিদ্ধান্ত নিতেই কেটে গেছে চারটি বছর। একজন বাদির একটি অভিযোগ মামলা হিসেবে গণ্য হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নিতেই আদালতের এ সময়ক্ষেপণ।
অভিযোগটিতে অভিযুক্ত ৩১ জনের  বেশির ভাগই পুলিশের প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ২০০৯ সালের ৫ এপ্রিল ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে অভিযোগটি করেন পুলিশেরই সাব-ইন্সপেক্টর মো: আবদুল জলিল। এতটা সময় অতিবাহিত হলেও তিনি আজো জানেন না তার অভিযোগটি আদৌ আলোর মুখ দেখবে কি না, অভিযুক্তরা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন কি না।

উল্লেখ্য ১৯৯১ সালে মিরপুরে পুলিশের লুটকৃত রাইফেল উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার অভিযানের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তার রোষানলে  পড়েন আবদুল জলিল। কেননা সন্ত্রাসী বাহিনীর তালিকায় ওই কর্মকর্তার দুই ভাই ছিলেন। সেখান থেকেই ঘটনার সূত্রপাত।

এ দিকে অভিযুক্তদের আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানোর উদ্যম হারিয়ে তিনি এখন পিছু হটার দলে। মামলা না হলে অন্তত অভিযোগটি খারিজ করে দিয়ে দায় মুক্তি চান আবদুল জলিল। কিন্তু তা-ও জুটছে না এ ভাগ্যাহতের। আদালতের ডাকে এ পর্যন্ত তাকে ২৫ বার হাজির হতে হয়েছে। আদালতের বারান্দায় ঘুরে পার হয়েছে দিনের পর দিন। শুনানি ও অধিকতর শুনানির জন্য তাকে প্রতিবারই দাঁড়াতে হয়েছে কাঠগড়ায়। দিতে হয়েছে অভিযোগের কৈফিয়ৎ। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তিনি সীমাহীন হয়রানি ও উকিল-মোক্তার পোষার মতো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন সেই অভিযুক্তদের একবারের জন্যও আদালতে আনতে পারেননি। আবদুল জলিল বলেন, জানি না আদৌ মামলা হবে কি না, হলেও তা শেষ হবে আমার মৃত্যুর পরে।

জানা গেছে, অভিযোগ করার সময় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ ছিলেন মো: আজিজুল হক। ওই বিচারকের পদোন্নতির পর বিচারক হিসেবে আসেন মো: বশির উল্লাহ। তার আদালতেও বারবার অভিযোগটি গ্রহণ হবে কি হবে নাÑ সে বিষয়ে অধিকতর শুনানি অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু কোনো আদেশ দেয়া হয়নি। তারিখের পর তারিখ পড়ে। সে সময় তাকে বলা হয়, এত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেন মামলা করতে এসেছেন। টিকে থাকতে পারবেন তো? তখন অভিযোগকারী বলেছিলেন, হুজুর, দয়া করে একটা আদেশ দেন। অভিযোগটি গ্রহণ করেন নতুবা খারিজ করে দেন। তখন আদালত বলেন, ঠিক আছে, দেখে আদেশ দেবো। কিন্তু সে আদেশ আর দেয়া হয়নি। রাখা হয়েছে অধিকতর শুনানির জন্য।

অধিকতর শুনানি করেন বাদির আইনজীবী, কিন্তু আদেশ দেয়া হয়নি। এ পর্যায়ে ওই বিচারকের পদোন্নতি হলে নতুন বিচারক হিসেবে যোগদান করেন মো: জহুরুল হক। তিনিও আগের বিচারকের মতো শুনানি করলেও আদেশ দিতে পারেননি। তারিখের পর তারিখ পড়ে।

অভিযুক্তরা হলেনÑ তৎকালীন সিএমপি কমিশনার মনিরুজ্জামান, ডিএমপি কমিশনার মতিউর রহমান, এসি শহিদুল্লাহ চৌধুরী, ডিআইজি রাজশাহী রেঞ্জ মো: সহিদুর রহমান ভূঞা, এএসপি সিকিউরিটি সেল খন্দকার হাফিজুর রহমান মিল্কি, এসপি সিরাজগঞ্জ আনোয়ার হোসেন, সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, সিরাজগঞ্জ সদরের এএসপি মফিজ উদ্দিন আহমেদ, এসি ডিবি কুদ্দুস খান, সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর থানার ওসি তফফাজল হোসেন, এসি মতিঝিল জোন বুরহানউদ্দিন, সূত্রাপুর থানার ওসি আবু হেনা মোস্তফা, মিরপুর থানার ওসি নূরুল আলম, রাজারবাগ পুলিশ হসপিটালের ডা: আশরাফ হোসেন, আর ও সিরাজগঞ্জ পুলিশ লাইন, মিরপুর থানার এএসআই শামসুল হক সরকার, মিরপুর থানার এসআই আরিফুল হক, এসি ও বিএসি সেগুনবাগিচার (দুদকের) হজিরুল হুদা। পুলিশ ছাড়া অন্য আসামিরা হলেনÑ পপুলার হাউজিং বড়বাগ, মিরপুরের মো: শহিদুল ইসলাম, ৫৮/১ নতুন সেনপাড়া, মিরপুর-১০, ঢাকার জমির আলি, একই ঠিকানায় আবু বকর, আকবর হোসেন খান ও গোলাম মোস্তফা, মিরপুরের হাবিবুর রহমান হবি, মিরপুর-২ এ ১৪/১ ইছাক কুঞ্জনের আবদুল মতিন, ৯৮৪ মনিপুর, মিরপুর-২-এর সামছুদ্দিন মোল্লা, ৫/১৫ বগবাগ, মিরপুর-২-এর সাখাওয়াত হোসেন সুজা, ২/১ বড়বাগ মিরপুর-২-এর সফি, ৫৭৩/১ মনিপুর, মিরপুরের মির শাহজাহান ও প্লট নং ১৫, রোড নম্বর ৫, বসতি প্রপার্টিজ, বড়বাগ, মিরপুর, ঢাকার দেওয়ান লুৎফুর রহমান।

অভিযোগকারী বলেন, চার বছর কেটে গেলেও ওই অভিযোগটি এখন পর্যন্ত মামলা হিসেবে গ্রহণ সম্পর্কে কোনো আদেশ দেয়নি। মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের অর্ধেকের বেশি পুলিশ ও দুদকের কর্মকর্তা। কয়েকজন পেশাদার সন্ত্রাসী ও গডফাদার। এ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা চলবে কি না? এ সম্পর্কিত আদালতের জিজ্ঞাসারও আইনগত জবাব দিয়েছেন তিনি। দেখিয়েছেন কিভাবে চলবে সে আইনও। আবদুল জলিল বলেন, তারপরও প্রতীক্ষার পর প্রতীক্ষা করতে হচ্ছে। আদালত কী সিদ্ধান্ত দেন তা জানান জন্য। বাদি জানান, আসামিদের হুমকির মুখে এখন তার মরণদশা। এরই মধ্যে দুঃশ্চিন্তায় তিনি মারাত্মক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি আরো অভিযোগ করেন, ওই পুলিশ কর্মকর্তারা সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালাচ্ছে।

অভিযোগে যা রয়েছে : অভিযোগকারী মো: আবদুল জলিল মিরপুর থানার এসআই পদে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় ৪ সেপ্টেম্বর ’৯১ সন্ধ্যায় সহকারী দারোগা সুবলচন্দ্র ও তার সঙ্গীয় ফোর্সদের রামদা দিয়ে কুপিয়ে অভিযুক্ত সন্ত্রাসী হাবিবুর রহমান, তার ভাগিনা বর্তমানে মৃত সাহাবুদ্দিন, আবদুল মতিন, সামসুদ্দিন মোল্লা, আবদুল হামিদ, সাখাওয়াত হোসেন সুজা, শফি, শাহাজাহান ও শহিদসহ অন্যরা একটি রাইফেল ও গোলাবারুদ লুট করে। সে রাতেই অভিযোগকারীর নেতৃত্বে একটি টিম অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার করে। এতে তৎকালীন সিএমপির কমিশনার মনিরুজ্জান মারাত্মক ুব্ধ হন। তিনি আসামিদের পূর্বপরিচিত হওয়ায় আবদুল জলিলকে তার রোষানলে পড়তে হয়। উল্লেখ্য আসামি জমির আলি ও আবু বক্কর পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামানের ভাই।

এর পর থেকেই সন্ত্রাসীরা তার পিছু নেয়। ১৯৯৯ সালে অভিযোগকারী হাউজ বিল্ডিং থেকে ঋণ নিয়ে মিরপুরে বাড়ি নির্মাণ করতে গেলে সন্ত্রাসীরা তার জমির জাল দলিল তৈরি করে এবং চাঁদার জন্য তাকে হয়রানি শুরু করে। তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবিতে তার কাজ বন্ধ করে দেয়। তখন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিচারের আবেদন করেও অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের তদবিরের কারণে একজন পুলিশ সদস্য হয়েও তিনি প্রতিকার পাননি। উপরন্তু তার চাকরি যাওয়ার উপক্রম হয়।

আবদুল জলিল এসআই থেকে ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতির জন্য ২০০২ সালে মনোনীত হলে পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের প্ররোচনায় ডিআইজি সহিদুর রহমান ভূঁইয়া, এসপি আনোয়ার হোসেন তার পদোন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান। এবং পরে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এর আগে ২০০০ সালে তার নির্মাণাধীন বাড়ির মালামাল চুরি করে উল্টো তার বিরুদ্ধেই মিরপুর থানায় ছিনতাই মামলা করে। পুলিশের সিকিউরিটি সেলের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তাকে দফায় দফায় রাজশাহী রেঞ্জ ও সূত্রাপুর থানায় বদলি করায়। এবং তার কাছ থেকে বদলি ঠেকাতে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করে। তখন তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রিকায় মিথ্যা খবরও প্রকাশ করা হয়।

এরপর জলিল যেখানেই গেছেন তাকে খেতে হয়েছে ঠোকর। নিজ বিভাগের কর্মকর্তারা তার সাথে করেছেন অমানুষিক আচরণ। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তিনি আইনের আশ্রয় পাননি। হয়েছেন চরম হয়রানির শিকার। অবশেষে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন। বর্তমানে তিনি মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত।

অভিযোগকারী তার অভিযোগে বলেন, পুলিশের ওই কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় থাকা সন্ত্রাসী মীর শাহজাহান, জমির আলী, আবু বকর, আকবর হোসেন, গোলাম মোর্তুজা, হাবিবুর রহমান হবি, আবদুল মতিন, সামসুদ্দিন মোল্লাসহ তাদের অন্য সহযোগীরা জাল দলিল তৈরি করে অন্যের জমি দখল, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, জীবননাশের চেষ্টাসহ ভয়ভীতি প্রদর্শন করে জুয়া ও মদের আসর বসিয়ে টাকা লুটে নিয়ে এলাকাবাসীর অনেককেই করেছে সর্বস্বান্ত। এতে উল্লিখিত পুলিশ কর্মকর্তারা মদদ দিয়ে আসছেন। ফলে সন্ত্রাসীরা নির্বিবাদে তাদের এসব কর্মকাণ্ড চালাত। আর এসব কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়ায় বাদির চাকরিচ্যুতি ঘটায়। দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলেও বাদির আনীত অভিযোগটির বিষয়ে আদালতের কোনো সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় বাদি হতাশ হয়ে পড়েছেন।

বিশেষজ্ঞ অভিমত : এ ব্যাপারে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী টি এম আকবর বলেন, একের পর এক তারিখ দিয়ে সময়ক্ষেপণ করার কোনো যুক্তিকতা নেই। আদালতের উচিত ছিল অভিযোগ গ্রহণ করা, না হয় নাকচ করা।

ঢাকা মেট্রো বারের সাবেক সভাপতি শাহ ইলিয়াস রতন বলেন, বাদির অভিযোগ গ্রহণ করা বা না করা আদালতের এখতিয়ার। তবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করা ঠিক হয়নি।

মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি শাহ আলম তালুকদার বলেন, বাদি যে সময় অভিযোগটি আদালতে দায়ের করেছেন সে সময়ই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিলে এত সময়ক্ষেপণ হতো না। গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে ঝুলিয়ে রাখার কোনো যুক্তি দেখি না।

ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি মো: আওলাদ হোসেন মোল্লা বলেন, যেকোনো আদালতেই মামলা  করা হোক না কেন? সুয়োমোটো রিজেক্ট করবে না হয় যথার্থ বক্তব্য দিতে পারলে তা গ্রহণ করবে। অহেতুক সময়ক্ষেপণ করে ঝুলিয়ে রাখার কোনো আইনগত কারণ নেই। ঢাকার বিশেষ আদালত-২-এর পিপি ফরিদউদ্দিন আহমেদ বলেন, অভিযোগটি যদি চলে বা চলার যোগ্য হয়, সে ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করতে পারে। সময়ক্ষেপণ এ ক্ষেত্রে সঠিক হয়নি।

ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি শেখ হেমায়েত হোসেন বলেন, দীর্ঘ দিন ঝুলিয়ে রাখা সঠিক কাজ হয়নি, যা ন্যায়বিচারের অন্তরায়।

অ্যাডভোকট মো: খলিলুর রহমান বলেন, কোর্ট অযথা সময়ক্ষেপণ করেছেন। সাহসী পদক্ষেপ নিতে সঙ্কোচবোধ করেছে। আদালতের দায়িত্ব হচ্ছে অভিযোগটি গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া এবং গ্রহণ না করলে সরাসরি তা খারিজ করা।

এ ব্যাপারে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ মো: জহুরুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার আদালতে কোনো মামলা পেন্ডিং নেই।

No comments

Powered by Blogger.