শিক আন্দোলন ও রাষ্ট্রের ভূমিকা by ড. মো: হাবিবুল্লাহ ও মো: মাসুদ রানা

প্রাথমিক স্তরে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরি ধাপে ধাপে জাতীয়করণের ঘোষণা যেমন মানুষকে আশান্বিত করেছে।
ঠিক তেমনি নন-এমপিও শিাপ্রতিষ্ঠানের শিক-কর্মচারী ঐক্যজোটের ব্যানারে এমপিওর দাবিতে কয়েক দিন থেকে চলে আসা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের বাধা, টিয়ার গ্যাস নিপে ও লাঠি চার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ায় মানুষ হতাশ হয়েছে। শিকদের গায়ে হাত উঠানোর মতো এমন গর্হিত একটি কাজ সরকারের নির্দেশে পুলিশ করেছে, যা পুলিশের অবনতিশীল ভাবমূর্তিকে আরো ুণœ করেছে। শিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের কানেকশন তত্ত্ব দিয়ে পুলিশ বাহবা কুড়াতে চাইলেও তাদের এহেন নির্বুুদ্ধিতার পরিচয়েও মানুষ বিস্মিত হয়েছে। একটি ন্যায্য দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-সমাবেশের অধিকার সংবিধান প্রত্যেকটি নাগরিককে দিয়েছে (অনুচ্ছেদ-৩৭)। তাই এমপিওর দাবিতে শিকদের এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-সমাবেশে পুলিশের বাধা সংবিধানেরই লঙ্ঘন। বছরের পর বছর বেগার খাটুনি খেটে সমাজ-রাষ্ট্রের উপযোগী আদর্শ নাগরিক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের গড়ে তুলছেন শিকেরা, অথচ সেই শিকদের মৌলিক মানবিক অধিকারের নিশ্চয়তা নেই এমন নজির পৃথিবীর আর কোনো সভ্য সমাজে আছে কি না আমাদের জানা নেই। পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, এসব শিাপ্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া শেষ করে অনেক ছাত্রছাত্রীই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারসহ বড় বড় সরকারি-বেসকারি দায়িত্বশীল পদ অলঙ্কৃত করেছেন। অথচ কী নির্মম বাস্তবতা তাদের শিকদের ভাগ্যের আজো কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এখনো তাদের অধিকার আদায়ে রাজপথে নামতে হয়, দিনের পর দিন আন্দোলন করেও শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। রাজপথও যেন তাদের জন্য নিষিদ্ধ করেছে রাষ্ট্র। পুলিশি চরিত্রে অপমানিত-লাঞ্ছিত-ুব্ধ এসব শিক তাদের নাগরিক অধিকারও হারিয়েছেন রাষ্ট্রের কাছে। বাংলাদেশের সব আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার যে শহীদ মিনার সেখানেও শিকদের অবস্থানকে নিষিদ্ধ করেছে রাষ্ট্রের পুলিশ। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে  স্বার্থান্বেষী মহলও যে কত ঠুনকো আন্দোলনের নামে ব্যবহার করে এই মহান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে। অথচ শিকেরা তাদের ন্যায্য দাবিতে অবস্থান নিতে গেলেও তাদের নির্মমভাবে ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে রাষ্ট্রের পুলিশ। বলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপরে অনুমতি নেই। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন শিকদের ন্যায্য আন্দোলনকে দমাতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের মদদে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা পুলিশকে সাী রেখে শিকদের ওপর অন্যায়ভাবে হামলা করে নির্দয়ভাবে আহত করে তখন এসব সন্ত্রাসীর ক্যাম্পাসে প্রবেশের পূর্বানুমতির প্রয়োজন পড়ে না। অথচ অভুক্ত শিক যখন তার দাবির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত শহীদ মিনারে অবস্থান নিতে চায় তখন কর্তৃপরে অনুমতির প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর এহেন ভূমিকা সাধারণ মানুষের বিবেককে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। প্রেস কাব থেকে শহীদ মিনার, শহীদ মিনার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনেক্স ভবনের ফুটপাথ, ফুটপাথ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চ কোথাও যেন এসব শিকের ঠাঁই নেই। শিকদের যখন এই অবস্থা তখন আত্মপ্রচারে সদা তৎপর মাননীয় শিামন্ত্রী এবং শিাসচিবের ভূমিকা সচেতন মানুষকে আরো বেশি ব্যথিত করেছে। শিামন্ত্রী যখন তার নির্বাচনী এলাকায় জনসংযোগে (আগামী ১৬ তারিখ পর্যন্ত) ব্যস্ত তখন তার (শিা) সচিব মালয়েশিয়ার প্লেনে উড়াল দিয়েছেন কারিগরি বিষয়ে কোনো একটি সম্মেলনে যোগদান করতে। দায়িত্বহীনতার এমন উদাহরণ কি তার মতো একজন সাবেক বামপন্থী রাজনীতিবিদের মানায়? আদর্শচ্যুত রাজনীতি আর কাকে বলে। সিলেটের কোনো এক অনুষ্ঠানে মাননীয় এই মন্ত্রী বলেছেন, শিকদের এমপিও দেয়ার মতো পয়সা সরকারর হাতে নেই। তা ছাড়া তিনি দাবি করেছেন শিা খাতে বরাদ্দের ৬৪ শতাংশ চলে যায় শিকদের বেতনভাতা দিতে। আরো একটি ডাহা মিথ্যা কথা মানুষকে বড্ড পীড়া দিয়েছে। শিকদের অধিকার রার জন্য বর্তমান সরকারই নাকি লড়াই করে যাচ্ছে। শিকদের দাবি আদায়ে বর্তমান সরকারের লড়াইয়ের এই দাবিটি বেশ হাস্যকর। শিায় যেখানে পৃথিবীর গড় বিনিয়োগ জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ সেখানে বাংলাদেশের হলো ২ দশমিক ২ শতাংশ। এই হচ্ছে শিা এবং শিকদের দাবি আদায়ে সরকারের লড়াইয়ের চিত্র। গত জুন মাসে নন-এমপিও শিকদের বেতনভাতা দেয়ার শিামন্ত্রীর আশ্বাসও যে একটি নিরেট মিথ্যা ছিল তা বলার অপো রাখে না। তা ছাড়া ফি বছর শিা খাতে রাষ্ট্রের বিশাল বাজেটে যে বড় বরাদ্দ তা-ও কি শুভঙ্করের ফাঁকি? সামরিক বাহিনী আধুনিকায়নের নামে সামরিক খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বরাদ্দের ফল স্বাধীনতার ৪২ বছরেও মানুষ পায়নি। তাই সম্প্রতি রাশিয়ার কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় ঋণে আট হাজার কোটি টাকার সমরাস্ত্র কেনার চুক্তি করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরের খবরে মানুষ উদ্বিগ্ন হয়। কাদের স্বার্থে এবং কোন প্রয়োজনে এই সামরিক অস্ত্রের সমারোহ তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। এমনকি ঊর্ধ্বতন আমলাদের যানবহানের তেল খরচের জন্য দৈনিক এক হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা করার প্রস্তাবেও মানুষ হতভম্ব হয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকায় কত লোকের ভাগ্য বদলে গেল অথচ শিকদের বেতন দিতে টাকা নেই, শুধু যে টাকা নেই তা নয়, এসব ভাগ্যবিড়ম্বিত শিকের কথা শোনার মতো সময় যেন নেই সরকারের।
টিআইবির রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১২ সালে সেবা খাতে আদায়কৃত ঘুষের পরিমাণের ভিত্তিতে প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী জাতীয়ভাবে বছরে প্রায় ২১ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকার তি হয়েছে। এই ঘুষের টাকাসহ হলমার্ক কেলেঙ্কারির দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং ডেসটিনিসহ অন্যান্য এমএলএম কোম্পানির টাকা উদ্ধার করা গেলে শিকদের শুধু এমপিও নয়, জাতীয়করণসহ প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুও দেশীয় অর্থায়নে করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা। এবং মোদ্দা কথা হলো, ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে এ সরকারের সদিচ্ছার কোনো লণই আজ পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। না হলে কী পদ্মা সেতু মামলায় আবুলদের রায় সরকার এমন নির্লজ্জ প্রচেষ্টায় মত্ত হয়।
শিার মান উন্নয়নে সরকারের কার্যক্রম কি শুধু পাসের রেকর্ড ও জিপিএ ৫-এর নজিরবিহীন সংখ্যা বৃদ্ধির অপতৎরতায় সীমাবদ্ধ থাকবেÑ তা-ও মানুষ জানতে চায়। কিন্তু এতে যে শিার গুণগতমানের পরিবর্তন হয় না তা বোঝার মতো কি যথেষ্ট প্রজ্ঞা মাননীয় শিামন্ত্রীর নেই? এ সংশ্লিষ্ট সরকারের উদারনীতি সর্বমহলে যথেষ্টই নিন্দিত হচ্ছে। কেননা যখন প্রথম জিপিএ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল, তখন হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র জিপিএ ৫ পেত। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এখন জিপিএ ৫-এর সংখ্যা এসএসসি পর্যায়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ৭০ হাজারেরও বেশি। আরো ভয়ঙ্কর তথ্য হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক, খ ও গ ইউনিটে ভর্তি পরীায় জিপিএ ৫ অর্জনকারীদের ২০১০, ’১১ ও ’১২ সালে অনুত্তীর্ণের হার যথাক্রমে ৫২, ৫৩ ও ৫৫ শতাংশ। শিকদের অভুক্ত রেখে শুধু বাড়িয়ে বাড়িয়ে নম্বর দিলেই শিার গুণগতমানের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুতরাং শিকেরা আজ যে দাবি আদায়ে রাজপথে, সেই দাবি পূরণ করে শিকদের শ্রেণিকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব কিন্তু সরকারের। বিগত কয়েক দিন শিকদের শ্রেণিকে অনুপস্থিতের কারণে বছরের শুরুতেই শিার্থীরা যে তির মুখে পড়ল তা-ও নেহাত কম নয় এবং বিষয়টির প্রতি সরকারেরও মনোযোগী হওয়া উচিত।
বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিকদের যে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত তা কি শুধুই মানবিকÑ রাজনৈতিক নয়? প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট শিক নেতারা যখন সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিনিময়ে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পে কাজ করার নির্লজ্জ উদাত্ত আহ্বান জানান তখন সরকারের এহেন অভিসন্ধির বিষয়ে যথেষ্টই সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ থাকে। মানুষের ন্যায্য দাবি মেটানোর বিনিময়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি মোটেই কাম্য নয়। তারপরও মানুষ চায় মানবিক হোক আর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য হোক, নন-এমপিও এসব শিকের দাবির ন্যায্যতাকে মেনে নিয়ে তাদের পেশাগত, বৈষয়িক ও সামাজিক
স্বস্তিময় জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করা হোক।
শিকদের আন্দোলন সংগ্রাম সফল হোক এটাই মানুষ প্রত্যাশা করে। সাথে সাথে সমাজ-রাষ্ট্রের কল্যাণে ভবিষ্যৎ আদর্শ নাগরিক তৈরিতে শিকদের আরো বলিষ্ঠ ভুমিকা দেখতে চায় মানুষ। নৈতিক অবয়ের হাত থেকে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রা করে ছাত্রছাত্রীদের নৈতিকতার যথাযথ বিকাশে শিকদের নিষ্ঠাপূর্ণ আচরণ বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় খুব বেশি প্রয়োজন। আদর্শ, নৈতিকতা এবং প্রযুক্তির সংমিশ্রণে সময়োপযোগী দায়িত্বশীল মানুষও বর্তমান প্রোপটে খুবই প্রয়োজন। কাজেই নিয়মানুবর্তিতা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও সুশৃঙ্খলার সমন্বয়ে আমাদের শিকদের দায়িত্ব পালনের যে ধ্র“পদী ঐতিহ্য রয়েছে, তাই আমাদের রাষ্ট্রের জন্য আদর্শ নাগরিক তৈরিতে কার্যকর অবদান রাখবে এমন প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের।
লেখকদ্বয় : যথাক্রমে গবেষণা সহযোগী, গ্লোবাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল স্টাডিজ বাংলাদেশ ও উন্নয়ন গবেষক
habib_umam@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.