প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরে সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন- সেমিনারে অভিমত

 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাশিয়া সফরকে মাইলফলক বলে মনে করা হচ্ছে। মঙ্গলবার ভোরের কাগজ আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।
কিন্তু ৭৫ পরবর্তী দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকায় বিষয়টি অনেকেই ভুলতে বসেছে। প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরের ফলে সে সম্পর্কের পুনরাবৃত্তি হবে। তাঁর এ সফর বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে না। তবে সেমিনারে রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয় ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, অস্ত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখা উচিত। তা ছাড়া এটি একটি রাজনৈতিক ইস্যু। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে কেবিনেট ডিভিশনে হলেও আলোচনা দরকার ছিল। তবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে একেবারেই ভিন্নমত পাওয়া গেছে। আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশেষজ্ঞরাবলেন, পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনে ঋণ চুক্তির আগে এটির সম্ভাবতা আগে যাচাই করা উচিত ছিল। সম্ভাবতা যাচাই ছাড়া এমনকি একটি বিদ্যুত কেন্দ্র্ স্থাপনের পরিকল্পনা করা বা কোন প্রকার চুক্তি সম্পাদন সমীচীন হবে না। তবে কেউ কেউ বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন একটি বিপজ্জনক প্রকল্প হলেও বাংলাদেশের পক্ষে এর কোন বিকল্প নেই। তারা বলেন, দেশের গ্যাস ও কয়লা দিয়ে জ্বালানি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। দেশের উন্নতির জন্য পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের কোন বিকল্প নেই।
অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেন, দেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে হলে বিদ্যুত উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে দশগুণ বৃদ্ধি করতে হবে। বিদ্যুত উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের কোন বিকল্প নেই। একবার এটি স্থাপন করতে পারলে কম খরচে বিদ্যুত পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, পাকিস্তান, ভারত ও চীনেও পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। তারা এর উৎপাদন দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তিনি বলেন, ঋণ চুক্তির আওতায় যে অস্ত্র কেনার কথা বলা হয়েছে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বর্তমান অবস্থান ধরে রাখতে পারলে নির্দিষ্ট মেয়াদের আগেই তা পরিশোধ করা সম্ভব হবে। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় উল্লেখ করে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত ও রাশিয়া ছাড়া কেউ আমাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এ সম্পর্ক ভুলতে বসেছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের ফলে সম্পর্কে নতুন দিক উন্মোচিত হবে।
তবে সেমিনারে বক্তৃতাকালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে একেবারেই ভিন্নমত পোষণ করেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ড. আব্দুল মতিন। তিনি বলেন, কোন প্রকার সম্ভাবতা যাচাই ছাড়া এ বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা সমীচীন হবে না। সম্ভাব্য সমীক্ষা, প্রকল্প প্রস্তাব, পর্যালোচনা এবং খসড়া চুক্তি নিয়ে আলোচনা ছাড়া কিভাবে রূপপুর প্রকল্পের চূড়ান্ত চুক্তির কাছাকাছি এসে গেলাম। চুক্তিপূর্ব প্রাথমিক সমীক্ষা ও পর্যালোচনা ছাড়া কোন চুক্তি সম্পাদন করলে তার পরিণাম চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মতোই হতে পারে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোন দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তি নেই।
বর্তমানে ১ হাজার মেগাওয়াট শক্তি সম্পন্ন দুটি চুল্লি স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু চুল্লির শীতলীকরণে যে পর্যাপ্ত পানির দরকার তা আছে কিনা তা যাচাই করা উচিত ছিল। বিভিন্ন কারণে দেশের নদ নদীর পানির প্রবাহ অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া চুল্লির একবার বিষ্ফোরণ ঘটলে রূপপুর বা তার আশপাশ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ৩০ লাখ লোককে সরিয়ে নিতে হবে এবং দীর্ঘদিন এ এলাকার বাইরে থাকতে হবে। সে ক্যাপাটিসি নেই দেশের। চুক্তিতে রাশিয়ার বিশেষজ্ঞদের ১০ বছর চুল্লি পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে বিশ্বের কোন দেশ এভাবে চুল্লি পরিচালনা করে দেয় কিনা তাও ভেবে দেখা দরকার। এ ছাড়া সরকারী হিসেবে ১ হাজার ক্ষমতা সম্পন্ন একটি চুল্লির মূল্য ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা অনুমিত হয়েছে। অথচ একই ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি চুল্লি ভিয়েতনাম রাশিয়ার নিকট থেকে কিনতে সম্মত হয়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকায়। পশ্চিমা দেশে এ চুল্লির দাম আরও বেশি। এ অবস্থায় রাশিয়া বাজার মূল্যের চেয়ে অর্ধেক দামে চুল্লি সরবরাহ করবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, রূপপুরে প্রত্যেকটি চুল্লির মূল্য ৩২ হাজার কোটি টাকার কম হবে না। এ অবস্থায় তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তাড়াহুড়া করার কোন প্রয়োজন নেই। প্রস্তুত না থাকলে প্রয়োজনে আরও অপেক্ষা করা যেতে পারে।
অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে সাংবাদিক ও কলামিস্ট জগলুল আহমেদ চৌধুরী বলেন, রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারে সরকারকে আরও স্বচ্ছতা বজায় রাখা উচিত। অস্ত্র কেনার অধিকার ও যৌক্তিকতাও সরকারের রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন না ওঠে সে ব্যাপারে অধিক স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সেনাবাহিনীর জেনারেল (অব) আব্দুর রশিদ বলেন, অস্ত্র কেনার বিষয় যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তাতে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, টাকা থাকলে বা ইচ্ছে করলেই যে কোন দেশ অস্ত্র কিনতে পারে না। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশের কাছে কোন দেশ অস্ত্র সরবরাহ করতে রাজি হয়নি। বাংলাদেশের অস্ত্র কেনার সামর্থ্য তখন ছিল না। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে এখন পর্যন্ত কোন প্রকার অস্ত্র সাহায্য করা হয়নি। তিনি বলেন, ইচ্ছা করলেই অস্ত্র কেনা যায় না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশেরও আগ্রহ থাকতে হবে। এ বিষয়ে রাশিয়া বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে রাজি হয়েছে যা একটি ইতিবাচক দিক। তিনি বলেন, এখন প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ রাশিয়ার তৈরি কোন অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে কিনা। তবে চীনের তৈরি অস্ত্র রাশিয়ার তৈরি অস্ত্রের ডামি কপি। ফলে অস্ত্র ব্যবহারের কোন অসুবিধা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক স্থাপনে সরকার এই সফরের মাধ্যমে একধাপ এগিয়ে গেছে। এর ফলে বহির্বিশ্বের বহুমুখী সম্পর্কের দিকে অগ্রসর হলো সরকার। তিনি বলেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সম্পর্ক একমুখী না করে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। তিনি বলেন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বাংলাদেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য কাজে লাগবে। বাস্তব পরিস্থিতি বাদ দিয়ে শুধু ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় পররাষ্ট্র নীতিকে দেখা ঠিক হবে না।
ভোরের কাগজ কার্যালয়ে অনুষ্ঠানে ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের বক্তব্য রাখেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন, মেজর জেনারেল আমিন আহম্মেদ, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট্রের চেয়ারম্যান মে. জে. মোহাম্মদ আলী শিকদার ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আব্দুল মান্নান।

No comments

Powered by Blogger.