শেষ ভাল যার ...

ড. মাহফুজ পারভেজ: মহান নাট্যকার শেকসপিয়ারের একটি নাটকের নাম ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’।
মহাজোট সরকারের চার বছর পূর্তিতে নানা জরিপ ও বক্তব্যের প্রেক্ষিতে শেকসপিয়ারের নাটকের কথাই প্রথম মনে পড়ল। ‘চার বছর কেমন ছিল’, সেটার চেয়ে ‘শেষ বছরটি কেমন যাবে’, সেটাই আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। শেষ বছরে যদি সবদিক রক্ষা করতে পারে, তবেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট শেষ হাসি হাসতে পারবে। এমনিতেই   সংখ্যাগত পরিসংখ্যান ও জরিপের সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক লক্ষণীয়। চার পত্রিকার জরিপ বলছে চার রকম কথা। একটি পত্রিকা তো অদ্ভুতভাবে লিখেই ফেললো, ‘সরকারের জনপ্রিয়তা কমছে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বাড়ছে।’ এটা কি বাস্তবসম্মত। সরকার আর শেখ হাসিনা কি আলাদা? এসব জরিপ বিশ্বাস করলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে সরকারই। কারণ সরকারকে এসব জরিপ নয়, প্রকৃত জনমতের হৃদস্পন্দন উপলব্ধি করতে হয়। বৈজ্ঞানিকভাবেই সংখ্যা দিয়ে মানুষের সুখ ও আনন্দ প্রকাশ করা যায় না। যেমন, বাংলাদেশের কয়েকটি গ্রামের নমুনা নিয়ে সেটাকে পুরো দেশের একটি সাধারণ চিত্র হিসাবে দেখানো হয়। একটি জেলায় কয়টি গবাদিপশু আছে, সেটাকে সব জেলার সঙ্গে গুণ করে পুরো দেশের পশুসংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এটাই জরিপ ও পরিসংখ্যানের সাধারণ নীতি। এছাড়াও যারা উত্তরদাতা হন, তাদের মনোভাবই জরিপ বা পরিসংখ্যানে প্রকাশ পায়। মহাজোটের চার বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা পরিমাপে জরিপ ও পরিসংখ্যানের চেয়ে সরেজমিন বিশ্লেষণ ও তৃণমূল তথ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা। সে পথেই দেখা দরকার সরকারের বিগত চার বছরকে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাফল্য ও সুশাসনের ক্ষেত্রে অর্জনের দিক থেকে বিগত চার বছরের সূচকগুলো  মোটেই উল্লেখযোগ্য নয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতির সুস্থতাও যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হয়েছে সরকারের কতিপয় উৎসাহী মুখপাত্রের কারণে। অহেতুক এমন অনেক কথা ও কাজ করা হয়েছে, যেগুলো লাভের চেয়ে ক্ষতি বাড়িয়েছে; উদ্বেগ-উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে। এতে সরকারের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দেয়। কখনও মনে হয়েছে মহাজোটের সরকার আওয়ামী লীগের সরকারে পরিণত হয়েছে। এরশাদের কথা আর বামদের কার্যক্রম দেখে তেমনই চাপা সঙ্কট আঁচ করা গেছে। সহযোগীসহ দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের সরকার, বিরোধী দলের আস্থাভাজন সরকার, নাগরিক সমাজের  বিশ্বাসের সরকারে উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে মহাজোট বিশেষ অগ্রসর হতে পারেনি। দেশে পলিটিক্যাল সোসাইটি এবং সিভিল সোসাইটি নামে যে একটি ক্ষমতাগত বিভাজন রয়েছে, সেটা বার বার মুছে ফেলার চেষ্টাও হয়েছে। ড. ইউনূস বা নাগরিক সমাজের সুশাসনের জন্য আন্দোলন বা পরিবেশ বা দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমকেও রাজনৈতিক লেবেল দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। সব কিছুকেই ‘আমাদের রাজনীতির পক্ষে’ কিংবা ‘আমাদের রাজনীতির বিপক্ষে’- এমন সঙ্কীর্ণ দলীয় মানদণ্ডে দেখার প্রবণতা সরকারের প্রধান চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। চার বছর আগে আওয়ামী লীগ যে বিশাল জনপ্রিয়তায় সরকার গড়েছিল, তেমন জনপ্রিয় ইমেজ ধরে রাখতে পারেনি মেয়াদান্তে; বরং বার বার দলীয় ক্ষুদ্রতায় আবর্তিত হয়েছে। আপস ও সমঝোতার বদলে সংঘাতের পথে চলে গেছে। শেষ বছরে দলীয় রাজনীতির ক্ষুদ্র বৃত্ত থেকে বের  হয়ে দেশের সব রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তির সঙ্গে সংঘাতের বদলে সংলাপ ও সমঝোতার সম্পর্ক গড়তে না পারলে জরিপ-পরিসংখ্যানের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বাস্তবতার মোকাবিলা করা যাবে না। নির্বাচনী ওয়াদা, কাজের ফিরিস্তি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বদলে মহাজোটের সামনে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট, অচলাবস্থা ও আগামী নির্বাচন প্রশ্নে সিদ্ধান্তহীনতা থেকে বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। আর এ কাজটি করতে হবে সবাইকে নিয়ে। শেষ বছরের সাফল্যের জন্য মহাজোট কি করে এবং কোন পথে অগ্রসর হয়- সেটাই এখন দেখার বিষয়।

No comments

Powered by Blogger.