পৌর নির্বাচন-নির্বাচন কমিশনে বাড়ছে প্রার্থীদের অভিযোগ-বিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ৫৫৬ ম্যাজিস্ট্রেট by কাজী হাফিজ

পৌরসভা নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীদের অভিযোগের সংখ্যা ততই বাড়ছে। নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন প্রায় সব অভিযোগকারীই। সন্দ্বীপ পৌরসভা নির্বাচনে নৌবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানানো হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যদের নিকটাত্মীয়রা যেসব পৌরসভায় প্রার্থী হয়েছেন, সেসব এলাকা থেকে প্রশাসনকে ব্যবহার করার আশঙ্কা জানিয়ে অভিযোগ আসছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, �এসব অভিযোগের সত্যতা
যাচাইয়ের কাজ চলছে এবং অভিযোগকারীদের দাবিগুলো আমাদের সক্রিয়
বিবেচনায় রয়েছে।�
এর আগে তিনি সাংবাদিকদের জানান, পৌর নির্বাচনে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২৯৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ২৫৬ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভোট গ্রহণের পরদিন পর্যন্ত মোট ১৩ দিন তাঁরা দায়িত্ব পালন করবেন।
যে ধরনের অভিযোগ : নির্বাচন কমিশনে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র পদপ্রার্থী কামালউদ্দীন চৌধুরীর অভিযোগ�ওই পৌরসভায় নেয়াখালী-৫ আসনের সংসদ সদস্য ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জা মেয়র পদপ্রার্থী। ফলে সেখানে প্রশাসনের সহায়তায় ভোটকেন্দ্র দখল করা হতে পারে। তিনি সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন।
অন্যদিকে ওই অভিযোগের জবাবে আবদুল কাদের মির্জা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, �অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে আমিও চাই এখানে সেনা মোতায়েন হোক।� তিনি বলেন, �আমার ভাই নির্বাচনী এলাকায় আমার পক্ষে প্রচার চালাতে এখন পর্যন্ত আসেননি, ভবিষ্যতেও আসবেন না। তবে কামালউদ্দীন চৌধুরীর জন্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ আসছেন। এতে নির্বাচনী পরিবেশের ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে। স্থানীয় প্রশাসন নিরপেক্ষভাবেই কাজ করছে। এ বিষয়ে আমাদের সহযোগিতা আছে এবং থাকবে।�
পিরোজপুর পৌরসভায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী নাসিমুদ্দিন খান নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছিলেন, স্থানীয় সরকার দলীয় সংসদ সদস্য এ কে এম আওয়ালের ছোট ভাই হাবিবুর রহমান মালেক মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ায় সেখানে স্থানীয় প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে না। মালেকের পক্ষে প্রশাসনকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
জানা যায়, নাসিমুদ্দিন খানের মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় বাতিল করে দেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার। পরে জেলা প্রশাসকের কাছে আপিল করলে সে আপিলও নামঞ্জুর করা হয়। নাসিমুদ্দিন এ অবস্থায় হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। হাইকোর্ট তাঁর মনোনয়নপত্র বৈধ বলে রায় দিলেও সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়। আপিলে হাইকোর্টের রায় তিন দিন স্থগিত করে আগামী বৃহস্পতিবার শুনানির দিন ধার্য় করা হয়েছে। এ অবস্থায় নাসিমুদ্দিনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকার বিষয়টি অনিশ্চিত। অন্যদিকে ওই পৌরসভায় দুজন মেয়র পদপ্রার্থী তাঁদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চলেছেন হাবিবুর রহমান মালেক ।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌরসভার দুজন মেয়র পদপ্রার্থী আলহাজ মো. নুরুল হক মুন্সী ও হাজি হুমায়ুন শিকদার নির্বাচন কমিশনের কাছে এক যৌথ অভিযোগপত্রে জানিয়েছেন, সেখানে সরকারি দল সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী এস এম রফিকুল আহসানের লোকজনের সশস্ত্র তৎপরতার কারণে তাঁরা ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় রয়েছেন। তাঁরা সেখানে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন। নুরুল হক মুন্সী জানান, গত ৩১ জানুয়ারি রাতে তাঁর বাড়িতে হামলা হয়েছে এবং নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
একই ধরনের অভিযোগে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন টাঙ্গাইলের মধুপুর পৌরসভার মেয়র পদপ্রার্থী শহীদুল ইসলাম। তাঁর অভিযোগ, ওই পৌরসভায় সরকারি দল সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী সারোয়ার আলম খানের বিরুদ্ধে।
নির্বাচন কমিশনের কাছে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী হাসানুজ্জামান চৌধুরী মিন্টুর লিখিত অভিযোগ, সেখানে আতঙ্কিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য তিনি দায়ী করেছেন সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থী আবু তাহের এবং তাঁর দুই ছেলে বিপ্লব ও টিপুকে।
এ অভিযোগের বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে আবু তাহেরকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মোবাইল ফোন থেকে জানানো হয়, তিনি নির্বাচনী বক্তব্য রাখছেন। তাঁর পক্ষ থেকে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আবু তাহেরের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ইসমাইল হোসেন বলেন, �ওই অভিযোগ ভিত্তিহীন। লক্ষ্মীপুর পৌরসভায় নির্বাচন নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বিনা বাধায় এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সব প্রার্থী তাঁদের নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।�
ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী কাজী আশরাফুল আজম তাঁর অভিযোগপত্রে বলেছেন, �শৈলকুপায় এক ধরনের কার্ফিউ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকেই একটি দলের মেয়র পদপ্রার্থী আনোয়ার হোসেন তৈয়ব ও তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী আমার কর্মী-সমর্থকসহ সাধারণ ভোটারদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে। এ অত্যাচার নির্যতিনের খবর ও ছবি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রিটানিং অফিসার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েও প্রতিকার মেলিনি। শৈলকুপা থানার ওসি আনোয়ার হোসেন তৈয়ব বাহিনীর পক্ষে ভূমিকা রাখায় পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ছে।� এ ধরনের ঘটনার ধারাবাহিকতায় ঝিনাইদহ সদর পৌরসভায় হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বলে আশরাফুল আজম আশঙ্কা করেছেন। গতকাল এ অভিযোগপত্র এবং অভিযোগের পক্ষে ছবি এবং ভিডিওর সিডি নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
প্রতি পৌরসভায় ম্যাজিস্ট্রেট : ছহুল হোসাইন জানান, আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন এবং গুরুতর অপরাধের বিচারিক কাজে প্রতি পৌরসভায় সাধারণভাবে একজন করে নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত থাকবেন। রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে এরই মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আর ঢাকা বিভাগে আগামী ৬ জানুয়ারি এবং সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে ৭ জানুয়ারি থেকে এ কার্যক্রম শুরু হবে।
নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন। তাঁরা সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কোনো প্রার্থীর পক্ষে মিছিল, জনসভা ও তোরণ নির্মাণ বন্ধ করে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন। মূলত তাঁরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মতো কাজ করবেন। নির্বাচনে গুরুতর অনিয়ম বা অপরাধের জন্য ব্যবস্থা নেবেন বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা। তাঁরা দায়ী ব্যক্তিদের দুই থেকে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দিতে পারবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে ছহুল হোসাইন বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের বাইরেও নির্বাচনের দিন মাঠে থাকবে কমিশনের নিজস্ব পর্যবেক্ষক দল। তারা ভোটের অনিয়ম-অসঙ্গতি কমিশনকে অবহিত করবে। ভোটের দিন মাঠ পর্যায়ের এসব কর্মকর্তার রিপোর্টের ভিত্তিতে কমিশন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কোনো সমর্থক আচরণবিধি ভঙ্গ করলে তার দায় প্রার্থীর ওপরেও বর্তাবে। এ ক্ষেত্রে উভয়েরই শাস্তি হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.