নূরুল আমীন ও তার ভ্রান্ত রাষ্ট্রভাষা নীতি- এমএ বার্ণিক

উপরোক্ত সমস্ত গুজবই একটি সুপরকল্পিত ধ্বংসাত্মক কার্যসূচীর অংশ বিশেষ জনসাধারণকে উত্তেজিত করিয়া আইন ভঙ্গ করা এবং তাহাদের মধ্যে আতঙ্ক ও বিভীষিকার সৃষ্টি করাই ইহার উদ্দেশ্য।
কমু্যনিস্ট কর্মপন্থা অনুযায়ীই এই সমস্ত চক্রান্ত পরিচালনা করা হইয়াছে। ঢাকায় হাঙ্গামা সৃষ্টি করিয়া কমু্যনিস্টরা দেশকে অরাজকতা ও বিশৃক্মখলার মুখে ঠেলিয়া দেওয়ার ষড়যন্ত্র করিয়াছিল এবং সরকারকে উৎখাত করিতে চাহিয়াছিল।
এ সম্পর্কে আমি কলকাতা হইতে প্রকাশিত কমু্যনিস্ট পার্টির মুখপত্র দৈনিক স্বাধীনতার দু'টি অংশ উদ্ধৃত করিতেছি। ইহা দ্বারা বুঝা যাইবে যে, কমু্যনিস্টরা কি করিয়া জনসাধারণকে সরকারের বিরুদ্ধে পোইয়া তুলিবার জন্য পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন সমস্যাকে নিজেদের কাজে লাগাইয়াছে। গত ১০ মার্চ ও ১১ মার্চের স্বাধীনতা উক্ত প্রবন্ধ দু'টি প্রকাশিত হইয়াছে। স্বাধীনতার বিশেষ প্রতিনিধি কর্তৃক এইগুলো প্রেরিত হয়।
ঢাকার সাম্প্রতি গোলযোগ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধে বলা হইয়াছে; প্রথম হইতেই পূর্ববঙ্গের কমু্যনিস্ট পার্টি ভাষা আন্দোলনকে ঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার কাজে সাহায্য করিয়াছে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠনের ব্যাপারেও পূর্ববঙ্গের প্রত্যেকটি জেলার সুদূরতম প্রান্তে ভাষা আন্দোলন ছড়াইয়া দেওয়ার ব্যাপারেও কমু্যনিস্ট পার্টি সাহায্য করিয়াছে।
প্রবন্ধটিতে আরও বলা হইয়াছে যে, নানাপ্রকার বিরোধ ও ষড়যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও কমু্যনিস্ট পার্টি ভাষা আন্দোলনটিকে পূর্ববঙ্গে সম্মিলিত গণআন্দোলনে রূপান্তরিত করিতে পারিয়াছে। ইহা দ্বারা পূর্ববঙ্গের কমু্যনিস্ট পার্টি অভূতপূর্ব সাফল্যের পরিচয় দিয়াছে।
আমি দেখিয়া অত্যন্ত মর্মাহত হইয়াছি যে, আমাদের একদল ছাত্র ও ঢাকার কিছুসংখ্যক লোককে বিভ্রান্ত করিয়া ও তাহাদিগকে বেআইনী কার্যকলাপে উদ্বুদ্ধ করিয়া পাকিস্তানের দুশমনগণ সাময়িকভাবে সাফল্য লাভ করিয়াছে। অপর প েগোলযোগের সঙ্গে সঙ্গে পরিষদের অভ্যন্তরেও অতিস্বল্প সংখ্যক সংখ্যালঘু প্রতিনিধি মুসলিম লীগ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করিতে মুসলিম জনসাধারণের প্রতিনিধিগণকে পীড়াপীড়ি করে। এই কার্যকলাপ অনুমোদন করিলে আমার সরকার দেশের জনসাধারণের সহিত বিশ্বসঘাতকাতা করিতে এবং দেশের নিরাপত্তা বিপন্নত্তা পরিত। আর ইহা দ্বারা গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করা হইত।
আমি ও আমার সহকমর্ীগণ যদি আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ওপর আপতিত এই হামলা ও অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধ করিতে ব্যর্থ হইতাম, তাহা হইলে আমরা আপনাদের নিকট, আমাদের জনসাধারণ ও আমাদের রাষ্ট্রের নিকট অপরাধী বলিয়া গণ্য হইতাম। যাহা হউক, আমাদের জনসাধারণ পরে এই গোলমালের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করিতে পারিয়াছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ৩ মার্চ আমার বেতার বক্তৃতার পর জনসাধারণ সর্বত্র এই সুপরিকল্পিত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ হইতে বিরত থাকিয়া পাকিস্তানের নিরাপত্তার আশ্বাস দান করে। আমি ভাবিয়া অত্যন্ত গর্ভবোধ করিতেছি যে, যে মুহূর্তে আমাদের জনসাধারণ বুঝিতে পারিল যে বৈদেশি চরগণ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নামে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করিতেছে, সেই মুহূর্তেই তাহারা সতর্কতা অবলম্বন করিল এবং দ্রুতবেগে দেশের সাহায্যর্থে আগাইয়া আসিল। আমি আরও আনন্দিত যে, ইহার ফলে আমাদের দুশমনগণ হতাশ হইয়া পড়িয়াছে।
রাষ্ট্রের দুশমনগণ এখনও গোপনে ও ছদ্মবেশে ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত রহিয়াছে এবং পুনরায় অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ খুঁজিতেছে। সন্ত্রাসবাদের দ্বারা জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক ও বিভীষিকার সৃষ্টি করিয়া তাহারা যে পাকিস্তানকে দুর্বল করার চেষ্টা করিতে পারে, তাহার কয়েকটি ইঙ্গিত পাওয়া গিয়াছে। নারায়ণগঞ্জের গোলযোগ আয়ত্তে আনার অব্যবহিত পরেই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি কর্তৃক একজন কনেস্টবলকে গুলি করিয়া হত্যা ও একজন আনসারকে জখম করার পশ্চাতে অনুরূপ ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত রহিয়াছে। ইহার পরে আকস্মিকভাবে একদিন ঢাকায় একটি দেশী বোমা বিস্ফোরণের সংবাদও পাওয়া যায়।
এই ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করিলে বুঝা যায় যে, দুশমনগণ অন্য উপায়ে পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের জনসাধারণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছে। ঢাকার সাম্প্রতিক শোকাবহ ঘটনাবলী হইতে যদি আমরা প্রকৃত শিা গ্রহণ করি তাহা হইলে দুশমনদের সর্বপ্রকার ষড়যন্ত্রই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইবে।
আমাদের স্বাধীনতা অত্যন্ত কষ্টার্জিত। আমাদের ল ল ভাইয়ের কোরবানির ফলেই পাকিস্তান অর্জিত হইয়াছে। কিন্তু ইহাকে রা করার কাজ আরও বেশি কঠিন। এই সন্ধিণে পাকিস্তানকে রার জন্য আমাদের সদাজাগ্রত প্রহরা ও বিপুল কর্ম প্রচেষ্টার প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি। _এপিপি
(সূত্র : দৈনিক আজাদ, ২৫ মার্চ ১৯৫২)।
এভাবে নূরুল আমীনের বক্তৃতা ও বিবৃতির মধ্যে তার প্রতিহিংসাপরায়ণতার চিত্র ফুটে ওঠে। ভাষা-আন্দোলনকারী নেতা-কমর্ীরা তার নিকট দেশের দুশমন ও ষড়যন্ত্রকারী মনে হলেও পরবতর্ীকালে তাদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশ ও জাতির গৌরবময় ইতিহাসের জন্ম দেয়।

No comments

Powered by Blogger.